১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ যখন বর্বর পাকিস্তানি সেনার অত্যাচারে জর্জরিত। ঠিক তখন পৃথিবীর অপর প্রান্তে একদল তরুণ গায়ক কন্ঠের শক্তি দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলেন বাংলাদেশের আর্তনাদ । নির্যাতিত মানুষের জন্য কণ্ঠের হাতিয়ার নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন জাগ্রত সুর সৈনিক হয়ে। তাদের মধ্যে একজন জর্জ হ্যারিসন।
প্রথা বিরোধী এই মার্কিন গায়ক নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পাশে ছিলেন সবসময় ,সংগীতের প্রতি অপার ভালবাসা থেকে ১৯৬৫ সালে ভারতের বিখ্যাত সেতার বাদক পন্ডিত রবি শঙ্কর সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ১৯৭১ সালে রবি শঙ্করের মাধ্যমে
বাংলাদেশের পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সংবাদ শুনে তার হৃদয়ে জন্মনেয় বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি । কন্ঠের শক্তিকে হাতিয়ার বানিয়ে দুই বন্ধু নেমে পরেন মার্কিন রাজপথে। যুদ্ধ কবলিত বাংলাদেশের সমর্থন এবং শরণার্থীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে প্রস্তুতি নেন ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের।
সেই সময় বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও যুদ্ধে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্রসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছিল তাই এই অবস্থায় মার্কিন মুল্লুকে বাংলাদেশের জন্য কনসার্ট আয়োজন সহজ ছিলনা। কিন্তু জর্জ হ্যারিসন থেমে যাননি, সমসাময়িক সকল শিল্পীদের শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তার ডাকে সারা দিয়ে সংগীত পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা বব ডিলান,এরিক ক্লাপ্টন, লিয়ন রাসেল, রিঙ্গে স্টারদের মত তারকারা। যে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের বিপক্ষের শক্তি হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত ,সেই মার্কিন মুল্লকে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশের সমর্থনে আয়োজিত হয় ,কানর্সার্ট ফর বাংলাদেশে,। কোনো যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সহায়তার উদ্দেশ্যে বৃহৎ পরিসরে আয়োজিত প্রথম দাতব্য কনসার্ট এটি। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ৪০ হাজার আসনের মধ্যে একটিও খালি ছিল না। দর্শকদের এই অভূতপূর্ব সাড়ায় শিল্পীরাও উজ্জীবিত। বিশ্ব মানবতার ডাকে জনতার ঢল জন সমুদ্রে পরিণত হয়।জর্জ হ্যারিসন গিটারের ঝঙ্কারে তুলে ধরলেন বাংলার নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ । গিটারের সুরের সাথে গর্জে উঠেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তার বিখ্যাত গান “বাংলাদেশ বাংলাদেশ” গেয়ে প্রতিবাদী করে তুলে পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে। গিটারের ঝংকারে কেঁপে উঠলো বিশ্ব বিবেক। কনসার্ট থেকে সংগৃহীত ২,৫০,০০০ ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেয়া হয়েছিল। এই কনসার্ট কেবলমাত্র আর্থিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, এরমধ্য দিয়েই বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা, গণহত্যার কথা, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আর্তনাদ বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়া হয়। মুক্তি প্রত্যাশী এই ভূখণ্ডের মানুষের কাছে জর্জ হয়ে উঠেন প্রাণের স্বজন, আত্মার আত্মীয়।
মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর
মৃত্যু হয় হ্যারিসনের। মৃত্যুর আট বছর পর হলিউড তাকে ‘স্টার অন দ্য ওয়াক অফ ফেম’
সম্মান দেয়। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের মৃত্যুবার্ষিকীতে
বিনম্র শ্রদ্ধা। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে জর্জ হ্যারিসনের সাথে সুরের বাধনে গড়া বন্ধন চির আটুট থাকবে হৃদয়ের বন্ধন হয়ে।