×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০২-০৮
  • ২৭৫৫ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের ইতিহাসে অপসাংবাদিকতার কারণে বরাবরই শিরোনাম হয়েছে কাতার ভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরা। এবারো এমনি এক সংবাদের কারণে আলোচনায় আল জাজিরা। 'All the Prime Minister's Men' বা 'ওরা প্রধানমন্ত্রীর লোক' শিরোনামে একটি তথাকথিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করেছে কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরা। এই রিপোর্ট ইতোমধ্যে সবাই দেখেছেন যেখানে বাংলাদেশকে অনেকটা মাফিয়া স্টেট হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একটি গণমাধ্যমে যখন গোটা রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গসমূহকে মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত বলে উল্লেখ করা হবে তখন অবশ্যই সেই রিপোর্টে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে। দুর্নীতি বা সন্ত্রাসবাদের অকাট্য প্রমাণ জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। কিন্তু আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ডকুমেন্টারিতে তাদের দাবীর পেছনে কোনরকম তথ্যপ্রমাণ ছিলো না। এমনকি পুরো রিপোর্ট একজন ‘সামি’ নামধারী ব্যক্তির বক্তব্যের উপর প্রতিষ্ঠিত যেসব বক্তব্যের কোন সত্যতাও রিপোর্টে দেখাতে পারেনি আল জাজিরা। কিন্তু যে সামিকে নিয়ে এতো বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে চেয়েছে আল জাজিরা সেই সামি সম্পর্কে এবার বেরিয়ে আসছে অনেক ভয়াবহ তথ্য। গোয়েন্দা সংস্থা সামির বিরুদ্ধে তদন্তে নামলে নানা অজানা তথ্য সামনে আসতে শুরু করে। দেশে থাকাকালীন বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে অংশ নেওয়ার দরুণ র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া, সেনানিবাসে নিষিদ্ধ হওয়াসহ নানা অপরাধে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে তারা। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সামি কখনো তানভীর সাদাত, কখনো শায়ের জুলকারনাইন, কখনো বা জুলকারনাইন শায়ের খান সেজে প্রতারণাসহ অগণিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। র‍্যাবের কর্মকর্তা পরিচয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে ২০০৬ সালে র‍্যবের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিলেন সামি। সর্বশেষ গুজব ও অপপ্রচারের অভিযোগে ২০২০ সালের মে মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামিও এই সামি। 

সামির প্রকৃত নাম সামিউল আহমেদ খান। অল্প বয়সে মাকে হারানোর পর চুরি ও প্রতারণামূলক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে বদলে ফেলেন মায়ের রাখা নাম ‘তানভীর মোহাম্মদ সাদাত খান’। বাবা অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মো. আবদুল বাসেত খানের চার সন্তানের মধ্যে সবার বড়। জন্ম ১৯৮৪ সালে হলেও স্কুলের তথ্য মোতাবেক তার জন্মতারিখ ১৯৮৬ সালের ৮ অক্টোবর। ১৪ বছর বয়সে সামি মাকে হারায়। এর দুই বছর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ মায়ের সংসার থেকেই অন্ধকার জগতে পা বাড়ায় সামি। মদ ও গাঁজা সেবন এবং শিক্ষার্থীদের সাথে অসভ্যতা ও নারী নির্যাতনের কারণে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে ভর্তি হয় কুমিল্লার ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলে এন্ড কলেজে যা এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নিশ্চিত করেন সামির ইস্পাহানি স্কুলের সহপাঠী ‘সাইফ এম ইশতিয়াক হোসেন’। 


 সামিউল আহমেদ সামি প্রতারণা ও চুরিতেও হাত পাকায়  কৈশোর বেলাতেই।  মাত্র ১৭ বছর বয়সে ২০০০ সালের ৩০ জানুয়ারি ইসিবিতে কর্মরত মেজর ওয়াদুদের বিদেশ থেকে আনা ট্রাকস্যুট চুরি করে ধরা পড়ে সে। ২০০০ সালের জুলাই মাসে টাইগার অফিসার্স মেস থেকে হাতির দাঁত চুরি করে চট্টগ্রামের নিউমার্কেটে অবস্থিত অঙ্গনা জুয়েলার্সে বিক্রি করেও ধরা পড়ে। বাবার চাকরির সুবাদে নিজেকে কখনো সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, কখনো ক্যাপ্টেন হিসেবে পরিচয় দিত সামি। সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়েই এক সেনা কর্মকর্তার মেয়েকে বিয়েও করেছিলেন সামি। ২০০১ সালের ২৮ ও ২৯ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাসে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করে সে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বন্ধু উৎপলের কাছে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে প্রমাণের জন্য বেল্ট, বুট ও র্যাঙ্ক ইউনিফর্ম কেনে সামি। উৎপলের বাসা থেকেই সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরে ট্যাক্সিক্যাব দিয়ে সেনানিবাসসহ ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকা অফিস, রাপা প্লাজা, ধানমন্ডি ও চিড়িয়াখানা ঘুরে জাহাঙ্গীর গেট হয়ে সিএমএইচে প্রবেশের সময় বেলা ২টায় মিলিটারি পুলিশের (এমপি) হাতে ধরা পড়ে সামি। এর ঠিক দুই দিন পর ২ মে বাবার অঙ্গীকারনামায় আর্মি এমপি ডেস্ক থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

 সামি ২০০৩ সালে বনানির ইন্টিগ্রেটেড সিকিউরিটি সার্ভিসে চাকুরি করত এবং অর্থ চুরির অপরাধে তার চাকুরি চলে যায়। পরবর্তীতে ডিওএইচ এস মহাখালীতে এসএমএস সিকিউরিটি সার্ভিসে চাকুরি শুরু করে। অ্যান্টেনা ভাঙা ভিএইচএফ (ওয়াকিটকি) নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়ার নামে কয়েকজনের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছিল সামির বিরুদ্ধে। ব্যবসার কথা বলেও অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল সে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকেই সামিকে খুঁজছেন। ফলে বহুদিন প্রকাশ্যে আসতে পারে না সামি।

২০০৬ সালের ২০ জুলাই র্যাব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের এ জে টেলিকমিউনিকেশন থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার মোবাইল ফোন কিনে একটি ভুয়া চেক দেয় সামি। একইভাবে প্রাইজ ক্লাব নামক একটি কম্পিউটার ফার্ম থেকে ১০টি ল্যাপটপ কেনার কথা বলে ২টি ল্যাপটপের গুণগত মানের কথা বলে চেক দিয়ে ২টি ল্যাপটপ নিয়ে আসে সে। চেক ডিজঅনার হলে অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-১ তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হবার পর জামিনের জন্য তার বাবা ঢাকায় আসেন এবং জামিন আবেদন খারিজ হবার পর ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাবার পথে বাবা স্ট্রোক করেন। এ ঘটনার পর তাকে এনপিজি ঘোষণা করে সব সেনানিবাস ও দফতরে অবাঞ্ছিত করা হয়।

পরবর্তীতে চ্যানেল ওয়ান প্রতিষ্ঠা হলে ঐ চ্যানেলের ইভেন্ট ডাইরেক্টর হন সে। কিন্তু নিজেকে এক্সেল ইভেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। তারেক জিয়ার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন যৌথবাহিনীর কাছে দেয়া লিখিত জবানবন্দীতে যে সামির কথা উল্লেখ করেছেন এই হলো সেই সামি। গিয়াসুদ্দিন আল মামুন জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘সামি আমার এবং তারেকের কাছে অদিতি সেন গুপ্তকে নিয়ে আসেন। আমি জেনেছিলাম সামির ‘এক্সেল ইভেন্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। বিদেশী নায়ক নায়িকাদের সাথে তার যোগাযোগ আছে। পরে সামিকে আমি চাকরী দেই।’ তারেক এবং মামুনের সঙ্গে সামি ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন সিলভার সেলিমের মাধ্যমে। ২০০৬ সালের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সামি দেশ ত্যাগ করে বুদাপেষ্ট চলে যান । শ্বশুরের অর্থ ও তারেক জিয়া-গিয়াস আল মামুনের সম্পৃক্ততায় হাঙ্গেরিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করে সামি। এসময়ই সামি বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন হাঙ্গেরীতে। 

গত বছর সাইবার ক্রাইম ইউনিট অনলাইনে জাতির পিতা, শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কটূক্তি ও আপত্তিকর প্রচারণা এবং করোনাভাইরাস নিয়ে অপপ্রচারসহ বিভিন্ন গুজব রটিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে, তাদের অন্যতম শায়ের জুলকারনাইন সামি। ‘উই আর বাংলাদেশি’ পেজ থেকে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার অভিযোগে অভিযুক্তদের ল্যাপটপ ও মোবাইল অনুসন্ধান করে ১১ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পান গোয়েন্দারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাসনিম খলিল ও সামিসহ ওই ১১ জনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের মে মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়। এ মামলার প্রতিবাদে কলাম লিখেছিলেন আরেক অপপ্রচারকারী ডেভিড বার্গম্যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশকে টার্গেট করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার লক্ষ্যেই কল্পিত ফিল্মটি নির্মাণ করা হয়েছে। 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat