×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০৩-০৬
  • ৯৭৬ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

গত বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা। রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তি। একটি চায়ের দোকানের পাশে ১২-১৪ জন কিশোরের জটলা। পাশ দিয়ে এক তরুণী যাওয়ার সময় সেখান থেকে ভেসে এলো কটু মন্তব্য। কাছে গিয়ে এ প্রতিবেদক পরিচয় দিতেই তাচ্ছিল্যের সুরে একজন বলে, ‘আপনে এগুলো পেপারে লেইখ্যা দিবেন। ল্যাহেন, তাতে আমগো কিছু যায়-আসে না।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘শাকিল বেশি বাইড়া গ্যাছিল। ওরে ফালাই (হত্যা) দিছে আমগো পোলাপাইন।’

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাসা থেকে ডেকে নিয়ে বানানী স্টার কাবাবের পাশে রাস্তায় ছুরি মেরে হত্যা করা হয় কিশোর মো. শাকিলকে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ। তারা দায় স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছে।

কড়াইল বস্তির ওই কিশোরদের সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন জানায়, তারা সবাই বস্তিতে থাকে না। আশপাশের ধনী পরিবারেরও সন্তান রয়েছে তাদের মধ্যে। এমন অন্তত চারটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় সেখানে। শাকিলের বাবা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘শাকিলের হত্যাকারীরা বস্তির আশপাশের ছিনতাইসহ সব ধরনের অপকর্মে জড়িত। অথচ দেখার যেন কেউ নেই।’

এর আগে গত ১২ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর মুগদায় খুন হয় কিশোর মেহেদি হাসান। এ হত্যাকাণ্ডের পর ওই এলাকায় গিয়ে কয়েক কিশোরের সঙ্গে কথা হয়। তাদের একজন বলে, ‘ওরে (মেহেদি) কইছিলাম আমগো এলাকায় না আইতে। আবার বড় ভাইদের সঙ্গে দেহা হলে সালাম দিত না। আমগো ওপর মাস্তানি করায় ওরে খুন করছে আমগো দলনেতা।’ অনুসন্ধানে এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অন্তত ১৫ কিশোরের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোর জানায়, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ার গলিতে নিয়মিত তারা অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ২০টি হত্যার ঘটনা ঘটছে।

এর বেশির ভাগ ঘটনায় কিশোর অপরাধীরা জড়িত বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। আবার ২০১৮ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে হওয়া ৩৬৩টি ছিনতাইয়ের নেপথ্যেও ছিল কিশোর অপরাধীরা। প্রায় একই চিত্র ঢাকার বাইরেও। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান ছিনতাইকারীদের বড় অংশই কিশোর। তারা ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং, শ্লীলতাহানিতেও জড়িত।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে সজীব এবং বগুড়া, নারায়ণগঞ্জে আরো দুই কিশোরসহ অন্তত ৪০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিশোর গ্যাংয়ের বড় উদাহরণ হয়ে আছে বরগুনার নয়ন বন্ড। এ অবস্থায় পারিবারিক অনুশাসন, সংস্কৃতিচর্চা, খেলাধুলার সুযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এখনই এ ব্যাপারে গুরুত্ব না দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

ঢাকার শিশু আদালতের নথি অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর-তরুণদের সিনিয়র ও জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর পুলিশের তথ্য মতে, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছে।

রাজধানীতে ৩৩টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে এলাকাভিত্তিক খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ সংখ্যা শতাধিক। এক এলাকায় একাধিক গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে মিরপুর ও উত্তরায় সবচেয়ে বেশি গ্যাং সক্রিয়। গ্যাং সদস্যদের মধ্যে অনেক নামি-দামি স্কুলের শিক্ষার্থী, ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান রয়েছে। 

ডিএমপি সদর দপ্তর বলছে, কিশোর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে নতুন বছরের শুরুতে নতুন পরিকল্পনায় থানার পুলিশকে পাড়া-মহল্লায় খোঁজ নিয়ে তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম। তালিকা ধরে র‌্যাব-পুলিশের অভিযান জোরালো করা হবে।

র‌্যাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় কিছু বড় ভাইও রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকায় ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে ২৮২ জন কিশোর অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে। হাতিরঝিলে বেড়াতে যাওয়া সাধারণ মানুষকে উত্ত্যক্তের ঘটনায় গত ২৭ জানুয়ারি থেকে হাতিরঝিল ও আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০২ কিশোরকে আটক করা হয়।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা আবারও লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করতে আমরাও তৎপর রয়েছি। গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে পুলিশ সদর দপ্তর। এই ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ রাখছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইট স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ রেকর্ডে পাওয়া গেছে, ২০১২ সাল থেকে দেশে কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা শুরু হয়। ওই বছর ৪৮৪ মামলায় আসামি ছিল ৭৫১ জন শিশু-কিশোর। আবার ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, কিশোরদের বিপথগামী হতে দেওয়া যাবে না। কিশোর গ্যাং নামে কোনো দৌরাত্ম্য চলতে পারে না। এ কিশোর গ্যাংকে মোকাবেলা করতে সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে র‌্যাবের প্রতিটি টিম তৎপর রয়েছে বলে জানান র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।

কিশোর অপরাধ বাড়ার কারণ জানতে চাইলে অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান বলেন, আগের যে অনুশাসনগুলো ছিল এগুলো সমাজে কাজ করছে না। যেমন—সমাজের ভেতর পরিবার, প্রতিবেশী, এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চা, বন্ডিং এগুলো নষ্ট হয়ে ছন্দঃপতন ঘটছে। এর মধ্যে আকাশ সংস্কৃতির মূল্যবোধ ঢুকে পর্নোগ্রাফি, ড্রাগ—সব কিছু মিলিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের প্রাথমিক অবস্থানে আমরা আছি। এ ছাড়া কালচারাল কার্যক্রম, খেলাধুলা একদমই নেই। এসব কারণে কিশোর-তরুণরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাই শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat