×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০৩-০৭
  • ৯৪৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ রাজনীতির এক মহাকাব্য; এক অমর অনবদ্য সৃষ্টি। বাঙালির গর্বের ধন। সেদিন শ্বাসরুদ্ধকর ওই ভাষণ পুরো বাঙালি জাতিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অসীম সাহস ও মুক্তির স্বপ্নে জাগিয়ে তুলেছিল। বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসীর জন্য ওই ভাষণ এক অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ। দিন যত যাচ্ছে ততই ৭ মার্চের ভাষণের মহত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। ইতোমধ্যে এই অমূল্য ভাষণটি পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। একটি ভাষণ এমন করে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনকে ত্বরান্বিত করতে পারে তা একাত্তরের ৭ মার্চের আগে বিশ্ববাসীর জানা ছিল না। ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দ এখনও উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের গহীনতম তলদেশে আছড়ে পড়ে। ১১০৮টি শব্দের সে কী মোহনীয় অনুরণন! বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় এমন স্বপ্নজাগানিয়া শব্দের গলনাধার '(ক্রুসিবল)' এর আগে কখনও দেখা গেছে বলে জানা যায় না। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ- এই শব্দ তিনটি উচ্চারণ করেছেন। কী অপূর্ব সেই বাক্য গঠন ও বাক্য বিন্যাস! প্রমিত ও প্রাকৃত শব্দমালা মিলেমিশে একাকার। শব্দের উচ্চারণ, লয়ের ওঠা-নামা এবং বিশেষ বিশেষ শব্দের ওপর বাড়তি জোর দেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুর এই স্বতঃস্ম্ফূর্ত আবেগঘন ভাষণটি এমন শ্রুতিমধুর ও অনন্য হয়ে আছে আজ পর্যন্ত। একই সঙ্গে ভাষণটি গতিময়। যেন দ্রোহের আগুন ছড়ানো অসাধারণ একটি কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা। তথ্য, যুক্তিবাদিতা, প্রশ্ন, খেদ, বিষণ্ণতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, সংযম, হুঁশিয়ারি উচ্চারণ- একসঙ্গে এত বৈশিষ্ট্য ঠাঁই করে নিয়েছিল ওই কবিতায়। সেই কবিতা পাঠের সময় তার তর্জনীর হেলনি এবং অনন্যসাধারণ দেহভঙ্গি- সত্যিই দেখার মতো।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজীবন গণতান্ত্রিক। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন- যদি একজন সদস্যও যুক্তি দিয়ে তার প্রস্তাব দাঁড় করাতে পারেন তাহলে তারা তার কথা শুনবেন এবং মানবেন। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালে যখন এ ভাষণকে 'বিশ্বঐতিহ্য সম্পদ' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে 'ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার'-এ স্থান করে দেয়; মোটেও অবাক হইনি। ভাষণটি একেবারে জীবন্ত। যখনই শুনি তখনই মনে হয়, এই প্রথমবার শুনলাম। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক 'নিউজউইক' ৭ মার্চের ভাষণটিকে আধুনিক কবিতার মতো মনে করেছে। বঙ্গবন্ধুকে 'পোয়েট অব পলিটিক্স' আখ্যা দিতে দ্বিধা করেনি। বঙ্গবন্ধু জানতেন, বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চলছিল। ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কিছুতেই বাঙালির উত্থান মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেও বিজয়ী দলের নেতাকে আক্ষেপ করে বলতে হয়েছিল- 'কী অন্যায় করেছিলাম?, কী পেলাম আমরা?' তখন বাংলাদেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। তবুও বঙ্গবন্ধু তার সৌজন্যবোধ বজায় রেখেছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে 'সাহেব' বলেই সম্বোধন করছিলেন। একজন প্রেসিডেন্টকে সম্মান দেখিয়েই তিনি তার ভাষণে অনুযোগ করে বলেছিলেন, 'তিনি (ইয়াহিয়া) আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।' তিনি ইয়াহিয়া খানকে সৌজন্য বজায় রেখেই বলেছিলেন, 'আপনি প্রেসিডেন্ট। কী  করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।'

৭ মার্চ এসেছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য এক অগ্নিপরীক্ষার দিন হিসেবে। সামনে লাখ লাখ সংগ্রামী জনতার গগনচুম্বী প্রত্যাশা। তাদের আশা, যে কোনো মুহূর্তে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। বিশেষ করে এ প্রশ্নে তরুণদের চাপ ছিল প্রবল। পেছনের দিকে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রস্তুত। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই গুলি। আকাশে জঙ্গি বিমান টহল দিচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতেও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা মাথা ঠান্ডা রেখে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ জানল- একতরফা স্বাধীনতা তিনি ঘোষণা করেননি; আর জনতা জানল স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো কিছুই তিনি মানবেন না। খুবই কৌশলে চারটি শর্ত জুড়ে দিলেন তিনি প্রস্তাবিত ২৫ মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে। সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক ব্যক্তিদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, নিরীহ মানুষকে হত্যার তদন্ত এবং জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর তিনি বিবেচনা করে দেখবেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তারা যোগ দেবেন কিনা। খুবই কৌশলী প্রস্তাব। এ চারটি শর্ত যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে মানা সম্ভব নয়, তা তিনি জানতেন। শর্ত পূরণ হলেও যে তার দল অধিবেশনে যোগ দেবে, তাও স্পষ্ট নয়। এমন করেই তিনি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার ফাঁদে পা দিলেন না। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া যে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের অবসান সম্ভব নয়- সে কথাটিও তিনি জানতেন। তবে সেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য চাই জনগণের ইস্পাতকঠিন ঐক্য। ২ মার্চ থেকে চলমান অসহযোগ আন্দোলনকে আরও তীব্র করার আহ্বান জানিয়ে তিনি জনতার ঐক্যকে আরও মজবুত করার উদ্যোগ নিলেন। একই সঙ্গে তিনি জনগণকে এটিও বুঝিয়ে দিলেন- দেশ পরিচালনার মূল চাবিকাঠি তার হাতে। অসহযোগ আন্দোলনটি ছিল কার্যত মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্ব। আগামী দিনের মুক্তির সংগ্রামে জনগণকেই যে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে- তা তিনি পরিস্কার করে দিলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানানোর মাধ্যমে।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান যেন জনতার মঞ্চ তথা আদালতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। জনতার সঙ্গে তার যে আত্মিক সম্পর্ক, তাই যেন সেদিন স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে প্রধান সেনানায়কের মতোই তিনি জনগণকে 'আপনাদের' থেকে 'তোমাদের' পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মুহুর্মুহু স্লোগান ও লাঠি দুলিয়ে তারা তাদের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতার কথায় সায় দিচ্ছিলেন। সে এক অসামান্য দৃশ্যপট। যখন তিনি বলছিলেন, 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি'; তখনই জনগণ বুঝে নিয়েছিলেন, এ জীবন তিনি বাজি রেখেছেন তাদেরই জন্য। তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। অতীতেও পাননি, ভবিষ্যতেও না। যখন তিনি 'মুক্তি' ও 'স্বাধীনতা' শব্দ দুটো গায়ে গা লাগিয়ে কৌশলে উচ্চারণ করলেন, তখন জনগণ তার মূল বার্তা পেয়ে গেছেন। 'জয় বাংলা' বলে তিনি ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পন্ন করেন। ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণার কিছু বাকি ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা 'একতরফা স্বাধীনতা' যে তিনি ঘোষণা করেননি- তাতেই আর পাল্টা আক্রমণ করতে পারল না।

এই ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা (লেখা দুটো প্রয়াত অধ্যাপক মমতাজউদ্‌দীন আহমদ, আমার এবং শাহরিয়ার মাহমুদ প্রিন্সের সম্পাদনায় প্রকাশিতব্য সংকলন 'মেঘনাদ কণ্ঠ'তে স্থান পেয়েছে)। শেখ রেহানা '৭ই মার্চের ভাষণে আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা' শিরোনামের নিবন্ধে লিখেছেন, '৭ই মার্চ সকাল থেকে আমাদের বাড়ির সবাই সেদিন খুব টেনশনে। কোথায় কোন ঘটনা ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে, খবর আসছে। আব্বাও প্রতিদিনের মতো সকালে উঠেছেন, চা খেয়েছেন, খবরের কাগজ পড়েছেন, দেখলাম অনেক্ষণ ধরে বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেদিন বেশ ধীর শান্ত, অথচ দৃঢ় একটা কাঠিন্য ছিল তাঁর চেহারায়। বেশ চিন্তামগ্ন ছিলেন।' মাকে উদ্ধৃত করে তিনি আরও লিখেছেন, 'তুমি নিজে যেটা ভালো মনে করবে সেই কথাই আজ বলবে। কারও পরামর্শমতো কিছু বলবে না। মনে রেখো, মানুষ আজ অনেক আশা নিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের তুমি নিরাশ করো না।' তাদের তিনি নিরাশ করেননি। অন্যদিকে, 'ভাইয়েরা আমার...' শিরোনামের এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা লেখেন (তার নিজের কথায়) "চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে তিনি ভাষণটা দিলেন, ঠিক যে কথা তাঁর মনে এসেছিল, সে কথাগুলিই তিনি বলেছিলেন। বাংলার মানুষের মনে প্রতিটি কথা গেঁথে গিয়েছিল। 'স্বাধীনতা' শব্দটি বুকে ধারণ করে তিনি যে- নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা দেশের মুক্তিকামী মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বিজয় অর্জন করেছিল। শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল।"

৭ মার্চ ১০ লাখ স্বাধীনতাকামী মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বিচক্ষণতা দেখাতে পেরেছিলেন তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, গণমানুষের মন বোঝার অসাধারণ সক্ষমতা এবং প্রবল বাস্তব জ্ঞানের কারণেই। এসব বহুমাত্রিকতার কারণেই ৭ মার্চের ভাষণটি আজ বিশ্বদরবারে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পেরেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
dratiur@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat