×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০৯-২৮
  • ৮৯২ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

কূটনৈতিক অংশীদারিত্বের গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছে ভারত-বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত অবস্থাসহ সার্বিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে দুদেশ।  কেবল রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের অথবা দুই দেশের সরকারের মাঝে যেনো এই সম্পর্ক আবদ্ধ না থাকে সেজন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে নানামুখী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ আরও সহজতর করতে দুই দেশের সরকারপ্রধান ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেআর এই অগ্রযাত্রায় দুই দেশের সরকার যাতায়ত ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত খাতে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে পেট্রাপোল সমন্বিত চেকপোস্টে নতুন একটি যাত্রী টার্মিনাল ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সীমান্ত স্থাপনাসমূহের আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে যৌথভাবে এটির উদ্বোধন করেন ভারত ও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। অনেক উৎসবমুখর পরিবেশে এই টার্মিনাল উদ্ভোধন করা হয়। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন যে দুই দেশের জন্য অনেক অর্থবহ তা এই টার্মিনাল উদ্ভোধনের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। এই উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষে ছিলেন দেশটির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায় ও নিশিথ প্রামাণিক। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের নৌ-পরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীও ছিলেন সেই টার্মিনাল উদ্ভোধনীতে। মূলত দুই দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থার যেকোন পর্যায়কে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব যে দেয় তার আরেকটি উদাহরণ এই টার্মিনাল উদ্ভোধনী।

সীমান্তের উভয় পাশের বিদ্যমান অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সহযোগিতার ঘাটতি দূরীকরণ এবং ব্যবসায়ীদের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে ভারত সরকার স্থল সীমান্তের প্রধান প্রধান প্রবেশ পথগুলোতে সমন্বিত চেক পোস্টগুলো গড়ে তুলছে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর আইসিপি পেট্রাপোল বাংলাদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এটি ভারতের নবম বৃহত্তম আন্তর্জাতিক অভিবাসন বন্দর, যা বছরে প্রায় ২৩ লাখ যাত্রীকে সেবা প্রদান করে। ভারতীয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্মিত, নতুন এক হাজার তিনশ পাঁচ বর্গমিটারের এই টার্মিনাল ভবনটিতে যে কোনও সময়ে ৫৫০ জন যাত্রীকে সেবা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনটি যাত্রীদের চলাচল ঝামেলামুক্ত ও সহজতর করবে এবং একই ছাদের নিচে যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, কাস্টম এবং সুরক্ষা সুবিধা দিয়ে সজ্জিত। ভবনে ৩২টি ইমিগ্রেশন কাউন্টার, ৪টি কাস্টমস কাউন্টার এবং ৮টি সুরক্ষা সেবা কাউন্টারের পাশাপাশি অন্যান্য অংশীদারদের জন্য পর্যাপ্ত কার্যালয় রয়েছে। এর বাইরে ভারতীয় স্থলবন্দর র্কতৃপক্ষ পেট্রাপোলে একটি অত্যাধুনিক যাত্রী টার্মিনাল ভবন (২) নির্মাণ করছে। যেটির মধ্য দিয়ে র্অধ মিলিয়ন যাত্রীকে সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল এবং ২০২২ সালের মধ্যে এটি শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রসারের জন্য সমন্বিত চেকপোস্টসহ স্থল শুল্ক স্টেশন ও সীমান্ত ফাঁড়ির ব্যবস্থায় দুই দেশ একীভূত হয়ে কাজ করছে। মোট সাতটি সমন্বিত চেকপোস্ট দুইটি পর্যায়ে সাজানো হয়েছে। পর্যায়-১: এ আছে, পশ্চিম বঙ্গের পেট্রাপোল (বাংলাদেশের বেনাপোলের সঙ্গে সম্পৃক্ত), মেঘালয়ের ডাউকি (বাংলাদেশের তামাবিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত), ত্রিপুরার আগরতলা (বাংলাদেশের আখাউড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত)। পর্যায়-২: এ আছে হিলি-পশ্চিমবঙ্গ (বাংলাদেশের হিলির সাথে সম্পৃক্ত), চ্যাংড়াবান্ধা-পশ্চিমবঙ্গ ( বাংলাদেশের বুড়িমারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত), সুতারকান্দি- আসাম (বাংলাদেশের শেওলার সঙ্গে সম্পৃক্ত), কাওয়াড়পুচিয়া-মিজোরাম (বাংলাদেশের তেগামুখের সঙ্গে সম্পৃক্ত)মূলত সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণকারী এজেন্সি যেমন- বহির্গমন, শুল্ক, সীমান্ত রক্ষী ইত্যাদি আইসিপিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। আইসিপিগুলো পর্যাপ্ত শুল্ক ও বহির্গমন কাউন্টার, এক্স-রে, স্ক্যানার,যাত্রীদের প্রয়োজনীয় জিনিস এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সুবিধাদি যেমন- পার্কিং, গুদামজাতকরণ,ব্যাংকিং, সার্ভিস স্টেশন, জ্বালানি স্টেশন ইত্যাদি সরবারহ সুবিধাসহ যাত্রী ও মালবাহীগাড়ির টার্মিনালগুলো নিয়ে একটি আধুনিক কমপ্লেক্সের মধ্যে অত্যাধুনিক সকল সুবিধা সম্বলিতসুরক্ষিত এলাকা হচ্ছে এই সমন্বিত চেকপোস্ট

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যে সুবিধার জন্য ২০১০ সালের ৪ জুন ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বিভাগ ৫০টি ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন বা স্থল শুল্ক স্টেশন (এলসিএস)-এর ঘোষণা প্রদান করেবাংলাদেশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১৮১টি ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনের ঘোষণা দিয়েছে। যদিও তার মধ্যে মাত্র ২৭টি কার্যকরী রয়েছে। অতিরিক্ত সুবিধার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনগুলো স্থল বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের সুবিধার জন্য ২০০১ সালে নৌ মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ (বিএলপিএ) প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থল বন্দর দিয়ে আমদানির উপর শুল্ক রাজস্ব আদায় সহজ করতে বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের মালবাহী গাড়ি ও গুদামজাতকরণ তদারক করার অনুমতি রয়েছে। ভারতে আন্তঃসীমান্ত মানুষ ও পণ্য চলাচলে আরও দক্ষ প্রশাসন ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রূপে ২০১০ সালে ভারত স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ (এলপিএআই) প্রতিষ্ঠিত হয়। এলপিএআই-এর অন্যতম একটি কাজ হল সমন্বিত চেক পোস্টগুলোর নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ তদারক এবং নিয়ন্ত্রণ করা। মূলত একটি সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন এক মাইলফলকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরেক অনন্য উদ্যোগ হলো সীমান্ত ফাঁড়ি। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে ভারত ও বাংলাদেশ স্থানীয় বাজারের মাধ্যমে স্থানীয় পণ্যসামগ্রী বাজারজাতকরণে বিদ্যমান প্রক্রিয়া পুনঃ সচল করতে পরীক্ষামূলকভাবে সীমান্ত জুড়ে নির্ধারিত এলাকায় সীমান্ত ফাঁড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়২০১০ সালের অক্টোবরে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত ফাঁড়ির উপর একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়। ইতোমধ্যে দুইটি সীমান্ত ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে: কলাইচর (মেঘালয়, ভারত- বালিয়ামারী (কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ) এবং দোলরা (সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ- বলাত (মেঘালয়, ভারত। ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ত্রিপুরা বর্ডারে শ্রীনগর সীমান্ত ফাঁড়ি উদ্বোধন করা হয়। ত্রিপুরা বাংলাদেশ সীমান্তের কমলাসাগর, পালবস্তি এবং কামালপুরে আরও তিনটি সীমান্ত ফাঁড়ির প্রস্তাবনা রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার একান্ত ব্যক্তিগত/পারিবারিক ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতে উৎপন্ন দ্রব্য সামগ্রী কিনতে পারে। সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতে এই পণ্যসামগ্রী স্থানীয় মুদ্রা মানে অথবা পণ্য দিয়ে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে বিনিময় করা যায়। এই সকল ক্রয়ের বরাদ্দকৃত মূল্য একটি নির্দিষ্ট দিনের জন্য ১০০ মার্কিন ডলারের স্থানীয় মুদ্রামানের বেশি হতে পারবেনা। সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতে বিক্রিত পণ্যের শুল্ক পরিশোধের পরে অবমুক্ত করা যায়।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ভিন্ন উচ্চতায় নিতে একাগ্র চিত্তে কাজ করছে দুদেশ। সমন্বিত চেকপোস্টের পাশাপাশি স্থল শুল্ক স্টেশন ও সীমান্ত ফাঁড়ির মাধ্যমে যাতায়ত ও যোগাযোগের যে সহজ মাধ্যম দুই দেশ তৈরি করেছে এতে নাগরিক সুবিধা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি বাণিজ্য সম্প্রসারণের নতুন দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। দুই দেশের সরকার আক্ষরিক অর্থেই শুধু সরকারে সরকারে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী নয় বরং মানুষে মানুষে যেনো সেই সম্পর্কের বিস্তার ঘটে সে লক্ষ্যেই কাজ করছে। কেননা মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক গড়ে উঠবে তা হবে চিরস্থায়ী, দুই দেশের মানুষের মাঝে যখন একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে তখন সেই সম্পর্ক হবে স্থায়ী ও মজবুত। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অমর হোক।

 

-হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।


তথ্যসূত্রঃ  ১। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, ভারতীয় হাই কমিশন।

২। ওয়েবসাইট, ভারতীয় হাইকমিশন।

৩। দৈনিক জনকন্ঠ। 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat