'যদি সৈয়দ আলী শাহ
গিলানি আমাদের শৈশব, আমাদের বাড়ি নিয়ে যা করেছিলেন তা স্মরণ
করি, তাহলে আমার আনন্দিত হওয়া উচিত। কিন্তু আমি ভাল
মূল্যবোধে বড় হয়েছি। তাই আমি শুধু প্রার্থনা করতে পারি যাতে জাহান্নামে আপনি
আপনার পাওনা পেয়ে যান।'
জম্মু ও কাশ্মীরের কাশ্মীরি
পণ্ডিত সম্প্রদায়ের নেতা সাহিল টিকুর এই বক্তব্যের মাধ্যমেই হয়তো গিলানির নির্মম
অত্যাচারের ধারণা কিছুটা পাওয়া যায়। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর কাছে
এক প্রিয়মুখ হয়ে উঠা গিলানি গত ১ সেপ্টেম্বর বুধবার শ্রীনগরে নিজ বাসভবনে শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা অনেকেই হয়তো এই গিলানির নাম
শুনেছি আবার অনেকেই হয়তো শুনিনি। যারা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির খোঁজ খবর রাখেন
তাদের কাছে সৈয়দ আলী শাহ গিলানি নামটি একদম অপরিচিত নয়। গিলানি ভারতের সবচেয়ে
উত্তপ্ত অঞ্চল কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। দীর্ঘ প্রায় চার দশকেরও বেশি সময়
ধরে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির মুখ হয়ে ওঠা কট্টরপন্থী এই নেতা ইসলামের
নাম করেই যুগের পর যুগ নিজ দেশের বিরুদ্ধে ধর্মীয় কার্ড খেলেছেন। ধর্মের নামে
উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সহিংসতা ছিলো তার এক ধরণের নেশা। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন জামাত-ই-ইসলাম
কাশ্মীরের নেতা। পরে তিনি তেহরিক-ই-হুরিয়ত গঠন করেন। ১৯৭২, ১৯৭৭ ও ১৯৮৭ সালে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের সোপোর আসন থেকে বিধায়ক নির্বাচিত
হয়েছিলেন এবং নির্বাচনে তার মূল অস্ত্রই ছিলো ধর্মীয় বিভাজন। জম্মু ও কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলির
সংগঠন অল পার্টি হুরিয়ত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার পালনও করেছেন
তিনি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জঙ্গিবাদের গুরু ছিলেন গিলানি।
গিলানির মৃত্যুর পর পন্ডিত
সম্প্রদায়ের নেতা সাহিল টিকু যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পেছনে রয়েছে এক নির্মম
নির্যাতনের ইতিহাস। গিলানির মৃত্যুর পর সেই বর্বরোচিত কাহিনী আবারো সামনে এসেছে।
সময়টা ছিলো ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখের রাত, যে রাতে হাজার হাজার
কাশ্মীরি পন্ডিত প্রায় এক বস্ত্রে কাশ্মীর উপত্যকায় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে
পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই রাতের ভয়াবহতা আজো আতংকিত করে প্রত্যক্ষদর্শীদের।
প্রচন্ড শীতের রাত, খেয়েদেয়ে কেউ টিভি দেখছিলেন আবার কেউবা শুয়ে পরেছিলেন। আচমকাই ‘আল্লাহু
আকবর’ ধ্বনি চারদিকে এবং 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ', 'ভারতীয়
কুকুররা ফিরে যাও' স্লোগানে কেঁপে উঠে কাশ্মীরি পন্ডিত
অধ্যুষিত অঞ্চল। মসজিদ থেকে হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে দলে দলে মানুষ গলি-মহল্লা
চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। অনেককেই সে রাতে হত্যা করা হয়। যে যেদিকে পারে ছুটে চলে
যেতে থাকে। আগুনে বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দেয়া হয়। সেই রাতের নির্মমতাই শেষ নয় বরং এরপর
থেকে কাশ্মীরি পন্ডিতদের পরিবারকে বেছে বেছে চিহ্নিত করে গিলানির নেতৃত্বে চালানো
হয় নির্মম নির্যাতন। এভাবে কাশ্মীরকে ধীরে ধীরে ‘কাশ্মীরি
পন্ডিত’ সম্প্রদায় শূন্য করে দেয়া হয়। সবাই
কাশ্মীর ছেড়ে অন্যপ্রদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। নিজের জন্মভূমি, জন্মস্থানকে রেখে
এক কাপরে পালিয়ে চলে আসতে হয় ভিন্ন স্থানে। আজ অবধি কাশ্মীরে ফিরে যেতে পারেনি
কাশ্মীরি পন্ডিত সম্প্রদায়। এখনো তারা তাদের জন্মস্থানে ফিরে যেতে সরকারের কাছে
দাবী জানিয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গিলানির হাতে গড়া
বিচ্ছিন্নতাবাদী দল ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছেনা। তাই
সৈয়দ আলী শাহ গিলানির মৃত্যুতে সাহিল টিকুর মতো হাজারো মানুষ তাদের সাথে ঘটা
নির্মম নির্যাতনকে সবার সামনে আবারো উপস্থাপন করছেন এক ক্ষীণ আশায়, যদি তারা ফিরে
যেতে পারেন নিজেদের জন্মস্থানে, নিজেদের বাপের ভিটায়!
গিলানিকে কাশ্মীরে থাকা ‘পাকিস্তানের
মুখপাত্র’ হিসেবেও অনেকে ডাকতেন।
পাকিস্তান প্রশ্নে তার ভূমিকার কারণেই এমনটা ডাকা হতো। এমনকি পাকিস্তান সরকারের
সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে তিনি আলাদা পরিচিতি লাভ করেছিলেন যার প্রমাণ ক্ষুদ
পাকিস্তানই দিয়েছে। গতবছর গিলানিকে সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়
পাকিস্তান। ২০২০ সালের ২৭ জুলাই পাক সিনেটের উচ্চকক্ষে সৈয়দ আলি শাহ গিলানিকে
সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ দেওয়ার
প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে পাশ হয়। শুধু
তাই নয়,
ওই প্রস্তাবে গিলানির নামে ইসলামাবাদের একটি বিশ্ববিদ্যলয়ের নামকরণ
করতে বলা হয়েছে সরকারকে। সেই সঙ্গে, জাতীয় ও প্রাদেশিক স্তরে
স্কুলের পাঠ্যবইতেও গিলানীর জীবনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে! জানলে অবাক হবেন
যে, পাকিস্তানের মেডিক্যাল কলেজে কাশ্মীরি পড়ুয়াদের জন্য বিনামূল্যে যে আসন
সংরক্ষিত করা রয়েছে সেখানে একক প্রভাব হচ্ছে গিলানির। গিলানি যা বলে পাকিস্তান
সরকার তাই করে। পাকিস্তান-অধিকৃত
কাশ্মীরের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়াসহ (যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ কর্তৃক
নিষিদ্ধ ঘোষিত) অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলি আইএসআইয়ের সহায়তায় ভারতে প্রবেশ করে যে
হামলা চালায়, সেটির ক্ষেত্রেও অনেক সময় নাম এসেছে গিলানির। পাক
অধ্যুষিত কাশ্মীরেও গিলানির প্রভাব ছিলো অনেক। আর সেকারণেই গিলানিকে ভারতে থাকা
পাকিস্তানের মুখপাত্র হিসেবে অনেকেই ডাকতেন!
নিঃসন্দেহে কাশ্মীরি পন্ডিতদের দেশান্তরে যাওয়া কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সস্প্রীতির সংস্কৃতির এবং কাশ্মীরিত্বের অত্যন্ত শক্তিশালী চেতনার উপর সবচেয়ে বড় আঘাত। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জন্মেছে যা ১৯৯০-এর আগে সম্প্রীতির সমাজে ছিলোনা। কাশ্মীরে আজ হিন্দু মুসলিম বিভেদ বা সন্দেহ যে পর্যায়ে গিয়েছে তার পেছনে দায়ী হচ্ছে এই গিলানি। বর্তমানে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর একটা পথ তৈরি হয়েছে কাশ্মীরি পন্ডিতদের কাশ্মীরে ফিরিয়ে আনার। ইতোমধ্যে এই প্রক্রিয়া নরেন্দ্র মোদীর সরকার শুরুও করেছে। গিলানির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হাজারো পন্ডিত হয়তো স্বপ্ন দেখছে নিজ ভূমিতে ফেরার। সময় বলে দেবে কাশ্মীরি পন্ডিতরা নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে আসতে পারবে কিনা তবে ১৯৯০ সালে যে ভয়াবহ এথনিক ক্লিনজিং এর শিকার তারা হয়েছিলেন তা কিন্তু আজো ভুলেন নি পন্ডিত সম্প্রদায়। আজো সেই দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় কাশ্মীরি পন্ডিতদের!
-হাসান
ইবনে হামিদ,
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।