‘জোড়ে
ভারত, জয় জগৎ’ স্লোগানকে সামনে রেখে
মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর থেকে একশো সদস্যের এক ভারতীয় দল সাইকেল র্যালী নিয়ে বাংলাদেশের
নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। গত ২ অক্টোবর ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা
গান্ধীর জন্ম জয়ন্তীর দিন এই সাইকেল র্যালীর যাত্রা শুরু হয়। ৭৫ দিনের এই সাইকেল
র্যালী যাত্রাপথে সাম্য, সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা ভারতের
অনেক শহর পাড়ি দিয়েছে, মন্দির মসিজদ, চার্চ, প্যাগোডা, আশ্রম, এতিমখানা কোনকিছুই
বাদ যাচ্ছেনা তাদের এই সম্প্রীতির মিছিল থেকে। এরকম নানা ধর্মীয় স্থান এবং
প্রতিষ্ঠানে যাত্রাপথে তারা যাচ্ছেন এবং তাদের ভালোবাসার বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে
দিচ্ছেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা গিয়েছে, ভারতের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের এলাকা
ছুঁয়ে, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা পরিক্রমা করে, তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আগামী
১৬ ডিসেম্বর গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত নোয়াখালীতে এসে শেষ হবে এই সাইকেল র্যালী।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের
প্রসঙ্গ আসলে সেখানে অবধারিতভাবেই ভারতের নামটি চলে আসে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে
এক কোটির বেশি শরণার্থীকে আশ্রয়সহ সশস্ত্র সংগ্রামে ভারত নানাভাবে দাঁড়িয়েছিল
বাংলাদেশের পাশে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে ভারতের
মানুষদেরও। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। তাই ভারতের
স্বাধীনতার ৭৫ বছর, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ়
করতে এবার ব্যতিক্রমী এই যাত্রা শুরু করেছে নারী-শিশুসহ ভারতের শতাধিক নাগরিক। ভারতের
পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর থেকে সাইকেল চালিয়ে বাংলাদেশে মহাত্মা
গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত নোয়াখালী আসার এই উদ্যোগ নিয়েছে ‘স্নেহালয়া’
নামক একটি সংস্থা। আয়োজকরা শুধুই যে উপরোক্ত কারণে এই সাইকেল র্যালী করছেন তা
কিন্তু নয় বরং তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, শুধু উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগকে
শক্তিশালী করার জন্য তারা এই আয়োজন করছেন না বরং ক্রমবর্ধমানভাবে ঘৃণা ও সহিংসতার
যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা সমাধানের প্রচেষ্টারও অংশ এই সাইকেল
র্যালী। একইসাথে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে তারা কি পেলো বা ভারতের স্বাধীনতা
আন্দোলনের অন্যতম নেতা পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার প্যাটেল
এবং গোপালকৃষ্ণ গোখলেরা যেমন ভারত চেয়েছিলেন তা এতবছরে এসেছে কিনা তা স্মরণ করিয়ে
দেয়ারও একটা চেষ্টা এই র্যালী। আর তাইতো, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা একসময় যে
আহমেদনগর দুর্গে ইংরেজদের হাতে বন্দী ছিলেন মহারাষ্ট্রের সেই আহমেদনগর থেকেই এই
সাইকেল র্যালীর সুচনা করেছেন আয়োজকরা। এই সাইকেল শোভাযাত্রায় সাহায্য করছে রোটারি
ক্লাব ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশ রোটারি ক্লাব। এ শোভাযাত্রায় পতাকা প্রদর্শনের জন্য
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শুধু
মুক্তিযোদ্ধার পরিবার নয় বরং আমরা সবাই অধীর অপেক্ষা নিয়ে বসে আছি ভারতের শতাধিক
নাগরিকদের এই অভযাত্রীদের বরণ করে নিতে।
অভিনব এই উদ্যোগটি দুই দেশের
নজর করেছে আরেকটি ভিন্ন কারণে। এই সাইকেল র্যালীতে এমন সব অসাধারণ ও প্রতিকূলতাকে
জয় করা মানুষ আছেন যারা ভিন্ন এক বার্তা দিচ্ছেন এই র্যালীতে উপস্থিত থেকে। সেসব
মানুষদের হয়তো আমরা চিনিনা কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সকল শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিত্ব
করছে এই সম্প্রীতি মিছিল। কেননা, এই একশো জনের দলে যেমন রয়েছেন ৬২ বছরের
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা সিদ্ধার্থ বাগমারে, তেমনি রয়েছেন ১০ বছরের
স্কুলছাত্র সিদ্ধার্থ আওয়ারে। এই দলেই আবার রয়েছে একহাতে সাইকেল চালানো অভিযাত্রী
দত্তু থোরাথ আবার অন্যদিকে কানে শুনতে না পাওয়া অভিযাত্রী রত্নাকর সেজওয়ার। রয়েছেন
সমাজকর্মী, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি ৬২ বছরের প্রবীন নারী হোমিও
চিকিৎসকও। তাই এই সাইকেল যাত্রাটি অন্য আর দশটি সাইকেল র্যালীর মতো নয়, এখানে
শারীরিক মানসিক সকল প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া
অভিযাত্রীরা ভালোবাসার টানে, সম্প্রীতির টানে সোহার্দ্যের টানে নিজেকে সাইকেলে
চড়িয়েছেন। ভেদাভেদহীন অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব গড়ার প্রতি হৃদয়ের টান না থাকলে এমন
চ্যালেঞ্জ নেয়া দুঃসাধ্য।
এমন একটি সময়ে এই সাইকেল র্যালী
ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে যখন কিনা এই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় খুব
বাজেভাবে দিনাতিপাত করছে। এমন এক সময়ে ভারতীয় বন্ধুরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির
বার্তা নিয়ে নোয়াখালী আসছেন যখন কিনা গান্ধীজির সময়ের বিপর্যস্ত নোয়াখলীর
প্রতিচ্ছবি হিসেবে বর্তমান নোয়াখালী তথা বাংলাদেশকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এবছর ১৩
অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের জেলায় জেলায় যে সাম্প্রদায়িক
সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে সেখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অশান্ত জেলা হিসেবে নোয়াখালীকে
আমরা দেখেছি। মন্দিরে মন্ডপে একের পর এক হামলা আমরা নোয়খালীতে হতে দেখেছি। তাই এই
সম্প্রীতির সাইকেল র্যালী বর্তমান বাস্তবতায় এক আলাদা গুরুত্ব বহন করছে, এক আলাদা
বার্তা সবাইকে দিচ্ছে। মহাত্মা গান্ধী বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের
চাষাবাদ করার প্রত্যয় নিয়ে আসা এই সাইকেল র্যালী আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই
পুরনো সময়ে, সেই নোয়াখালীতে যেখানে প্রায় তিন মাস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধের জন্য
মহাত্মা গান্ধী অবস্থান করেছিলেন। ভারত ভাগের এক বছরের মাথাতেই শুরু হয় হিন্দু
মুসলিম দাঙ্গা। সেসময় হিন্দু ও মুসলমান সমাজের পারষ্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ঘৃণা এমন এক অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছেছিল যার জেরে ১৬ই
অগাস্ট, ১৯৪৬ ঘটে যায় পূর্ব ভারতের ইতিহাসের কুখ্যাত
সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ - 'দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস'। দাঙ্গা শুরুর প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাণ হারান ৪,০০০ নিরীহ হিন্দু ও মুসলমান, এবং গৃহহীন হন এক
লক্ষেরও বেশি মানুষ। এই দাঙ্গায় নোয়াখালীতে চার সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার হিন্দু
ঘরবাড়ী হারিয়ে কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা
ও অন্যান্য জায়গার অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। এই পটভূমিতে
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নোয়াখালীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নোয়াখালীতে
অবস্থানকালে তিনি খালি
পায়ে মোট ১১৬ মাইল হেঁটে প্রায় ৪৭ টি দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম পরিদর্শন করেন।
এসময় তিনি নিয়মিত প্রার্থনা সভা পরিচালনা ছাড়াও স্থানীয় মুসলমানদের সাথে বৈঠক
করে হিন্দুদের আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটাই: এই
হানাহানি বন্ধ করে দুর্বলকে রক্ষা করা। সেই ভয়াল সময়ে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকাকে
আরেকবার স্মরণ করিয়ে সাম্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে এবার মহারাষ্ট্র
থেকে নোয়াখালী আসছেন এই অভিযাত্রীরা। এমন মহৎ একটি উদ্যোগ সত্যি প্রশংসার দাবী
রাখে।
সাম্প্রদায়িক মনোভাব পোষণ করা মানুষের সংখ্যা এই অঞ্চলে অনেক বেশি। ধর্মের ভিত্তিতেই আমরা দেখেছিলাম ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হতে। এই অঞ্চলের যাদের আর কোন অনুভূতি থাকুক আর না থাকুক ধর্মীয় অনুভূতি প্রবল! এখানে সংঘাত ছড়াতে মন্দিরে রাতের অন্ধকারে গরুর মাংস ফেলে রাখা হয়, একই ভাবে মুসলিমদের মসজিদ প্রাঙ্গণে জবাই করে রাখা হয় শুকর ছানা, এখানে রাতের আঁধারে মুসলমানের হাত ধরে কোরআন যায় মন্দিরে! এখানে তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতির নামে রাম মারে রহিমকে, রহিম মারে রামকে। রাম কেন হঠাৎ শিবের মূর্তি বসাবে কাবার ছবির উপর আর রহিমই বা কেন রামের দেব-দেবতাকে নিকৃষ্ট ভাষায় গালিগালাজ করবে ফেইসবুকের পাতায়! ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, দেশভাগের পর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার করপাড়ার জমিদার রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর বাড়িতে ভারত সেবাশ্রম সংঘের এক সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে ‘মুসলমানের রক্তে লক্ষ্মীপূজা দেয়া’র ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়ে নোয়াখালীর দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এভাবে প্রায় প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনাই পূর্ব-পরিকল্পিত, ব্যক্তিগত ভাবে রাম-রহিম কেউই লাভবান হয়নি এহেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়, লাভবান হয়েছে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষ বা রাজনৈতিক দল। আর এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে আপনার আমার হাত ধরেই। তাই সচেতন থাকতে হবে আমাদের, সচেতন সবাইকে করতেও হবে আমাদের। ভারত-বাংলাদেশ দু’দেশই এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে বারাংবার। তাই আমরা শান্তি চাই, ভারত-বাংলাদেশ যেহেতু ধর্ম কৃষ্টি কালচারে একে অপরের সাথে খুব বেশি সম্পর্কিত, তাই আমরা চাই আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সদ্ভাব যেনো বজায় থাকে। তাই এই সাইকেল র্যালীর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যে প্রচেষ্টা ভারতীয় নাগরিকেরা করছেন আমরা সেটার সাধুবাদ জানাই। আমরা চাই, ধর্মীয় বেড়াজালে যেনো নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়, রাষ্ট্র যেনো হয় সবার।
লেখক-