আজ মৌলবাদীদের যে আস্ফালন, এর বীজটি তারা রোপণ করেছিল উদীচীর উপর হামলা দিয়ে। বাংলদেশে প্রথম বোমা হামলাটি হয় উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে যশোরের টাউন হল মাঠে। কারণ মৌলবাদীরা জানে একটি জাতির সংস্কৃতিক আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে পারলে তার অগ্রযাত্রাকে দমন করা যায়। তাই উদীচী, ছায়ানটের উপর তাদের আক্রোশ। বাঙালি সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটন করতে পারলে মৌলবাদ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয় এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর। বাংলার সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভুলিয়ে তাদের ধর্মব্যবসা ধর্মের আড়ালে রাজনীতি করা সহজ হবে বলে মনে করেছে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী। কিন্তু একাত্তরে বুক দিয়ে জন্মভূমিকে আগলে রাখা জনগণকে চিনতে একটু ভুল হয়েছে জঙ্গিবাদীদের।
১৯৯৯ এর ৬ মার্চ যশোর বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন উদীচীর দশজন শিল্পী কর্মীসহ শতাধিক মানুষ, সেই শুরু। এরপর পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের আয়েজনে বোমা। পল্টনে সিপিবির সমাবেশে বোমা। দেশ জুড়ে বোমার তান্ডবে আবার হামলা হলো উদীচীর উপর, এবার হলো নেত্রকোনায়। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর সকাল আটটায় শহরের অজহর রোডের উদীচী কার্যালয়ের সামনে একটি লাল টেপ জড়ানো কৌটার দেখে মানুষ শতর্ক হয় পুলিশ আসে পানি ছিটায়। তারপর কৌটাটিতে খোঁচা দিলে সেটি সামান্য আকারে বিস্ফোরিত হয়। দুজন পুলিশ সামান্য আহত হন। এরপর ঘটনাস্থলে উদীচী কর্মীসহ সাংস্কৃতিক কর্মীরা সহ আরো অনেক মানুষ জড়ো হতে থাকেন। ঠিক সেই সময় এক আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী সাইকেলে চড়ে আসে এবং শক্তিশালী এক বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। আহত, নিহত, রক্ত, মানুষের আহাজারি, কান্না রক্তাক্ত মানুষের আর্তনাদ মর্মান্তিক এক মৃৃত্যিপুরীতে পরিণত করে অজহর রোডকে। বিস্ফোরণে নিহত হন আটজন মানুষ। নেত্রকোনা উদীচীর গণসঙ্গীত শিল্পী খাজা হায়দার খান ও নাট্যকর্মী যোদ্ধা নারী সুদিপ্তা পাল সেলিসহ ছয়জন খেটে খাওয়া মানুষ। কোন দোষে তাদের প্রাণ দিতে হলো তারা জানতেও পারলো না। আহতদের প্রথমে নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা খবর পেয়ে সজন হারানোর কান্না নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জড়ো হই সকলে। ঢাকা থেকে চিকিৎসার খবরাখবর নেয়া, সংকটাপন্নদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন শহিদমিনারে সকল সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠন নিয়ে বিক্ষোাভ সমাবেশ করা হয় শহিদ মিনার চত্বরে। সমাবেশ শেষে আমরা কয়েকজন রওয়ানা হই ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে আহতদের নিয়ে আশা হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। হাসপাতকলের সামনে পৌঁছাতে রক্তদানে ইচ্ছুকদের লম্বা লাইন দেখলাম গেইটের বাইলে থেকে। এই লাইনটি আমাদের বুকের সাহস অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলো, মানুষ মৌলবাদের পক্ষে না। মানুষ প্রয়োজনে সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য রক্ত দিতেও প্রস্তুত। সজনদের ব্যথায় কাতর অবস্থা দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। তাদের সামনেই আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছি আমরা। সবাইকে দেখে কথা বলে প্রয়োজনীয় সকল কিছু ব্যবস্থা করার ব্যাপারে ময়মনসিংহ ও কেন্দ্রীয় সংসদের সাথে যোগাযোগ করা হলো। উদীচী ময়মনসিংহ জেলা সংসদ সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করেছে নেত্রকোনার কর্মীদের সাথে। আমরা যুগে যুগে রক্ত দিয়েছি কিন্তু আমাদের এক মুহূর্তের জন্য থামিয়ে রাখতে পারেনি কেন শক্তি। যশোর হামলার পরে আরো শক্তি নিয়ে এগিয়ে ছিল উদীচী। নেত্রকোনা বোমা হামলার পরেও দুর্দমনীয় গতি কেউ রোধ করতে পারেনি। মৌলবাদের বিরুদ্ধে যেকোন আন্দোলন, মৌলবাদীদের প্রেসক্রিপশনে পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়ার প্রতিবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গণজাগরণ আন্দোলন, আজকের ভাস্কর্য রক্ষার আন্দোলন প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে উদীচী তার দায়িত্ব পালন করছে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে।
আমরা উদীচী একাত্তরের রক্তে অর্জিত বাংলাকে রক্ষা করবে, বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠায় ব্রতী থাকবে। সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করে একটি সমতার বাংলাদেশ গড়বে। এভাবেই আন্দোলন সংগ্রামে নিয়োজিত থেকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে এ ভূখন্ডের সংস্কৃতিকে। এই যশোর ও নেত্রকোনা বোমা হামলার শহিদদের দেয়া আমাদের রক্তশপথ। নেত্রকোনাসহ বোমা হামলায় নিহত সকল শহিদের প্রতি আনত শ্রদ্ধা। জয় উদীচী।
সহ সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
এ জাতীয় আরো খবর..