×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০১-২৫
  • ৭৯১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

২০১৯ সাল থেকেই গোটা বিশ্ব এক মহামারির কবলে পরেছে, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর উত্তাপ ছড়ায় ২০২০ সালে। করোনা মহামারির কারণে সকল দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সার্বিক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গিয়েছিলো। সব জায়গায় এক ধরণের অলিখিত স্থবিরতা এসেছিলো। তবে ২০২১ সালে করোনা মহামারি থাকলেও জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। টিকাকরণ কার্যক্রমও চলেছে জোরালোভাবে ফলে করোনা আক্রমণের প্রথম বছরের মতো দ্বিতীয় বছরটা এতো আতংকের মাঝে যায় নি। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের আগমন ঘটেছে বাংলাদেশে। নিয়ম রক্ষার সফর হিসেবে এই আগমনকে অনেকে ব্যাখ্যা করলেও তার বাইরে দু দেশের সম্পর্কের ভিত্তি বা অবস্থান মূলত প্রকাশ পেয়েছে এই সফরের মাধ্যমে। এই সফরগুলোর মাঝে আবারো আলোচনায় আসলো তিস্তা, অভিন্ন ছয় নদীর পানিবন্টন, ট্রানজিটসহ নানামুখী হিসেব নিকেশ। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে ২০২১ সালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নামটিই আসবে যারা ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ জ্বালাও পোড়াও করেছে, আগুন সন্ত্রাস করেছে। একদিকে আগুন সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম অন্যদিকে সেই একই গোষ্ঠী ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আগমনের কিছু আগে শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালানো, এসবকিছু যেনো এক ছকে বাধা। এর সাথে আছে সোশাল মিডিয়া ও মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমে নানারকম ফেক ও অস্বস্তিকর তথ্য যা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে খারাপভাবে উপস্থাপন করার এক ঘৃণ্য অপচেষ্টা। কিন্তু এতোকিছুর মাঝেও ২০২১ সাল এই দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে কোন বিভেদের দেয়াল তুলতে পারেনি।

২০২১ সালের মার্চ মাস, পূর্ব নির্ধারিত সূচী অনুযায়ীই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী  বাংলাদেশ সফরে আসলেন। শুধু নরেন্দ্র মোদী নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিরাও এই সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। বিশ্বের অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের এই আনন্দযজ্ঞে শামিল হয়েছেন। গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনে নানামুখী আয়োজনে ব্যস্ত, গভীর শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে তারা তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করছে, ঠিক সেই মুহুর্তকেই বেছে নিয়ে হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী চালাচ্ছে সন্ত্রাসী কার্যক্রম। আর এই সন্ত্রাসকে বৈধতা দিতে তারা পূর্বের ন্যায় এবারো খেলেছে ধর্মীয় কার্ড। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম নারকীয় তান্ডব দেশব্যাপী চালিয়েছে। প্রকাশ্য মিডিয়াতে মামুনুল হকরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছে।  নরেন্দ্র মোদীকে প্রতিহত করতে দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ারও হুমকি দিয়েছে। যেই কথা সেই কাজ, আমরা দেখলাম চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে হেফাজতে ইসলাম মিছিল নিয়ে এসে আচমকা হামলা চালায় হাটহাজারী থানা, ভূমি অফিস ও ডাকবাংলোতে। পুলিশ-হেফাজত সংঘর্ষে নিহত হয় চারজন৷ লাশ না পড়লে সহিংসতা জমেনা তা ভালো করেই জানে মামুনুল হকেরা, ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি এরা করছে অনেককাল আগে থেকেই। এবারো তারা তাই করছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে যে, 'আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ যারা করে তারা মুসলমান না, তাদেরকে হত্যা করা জায়েজ'এই ভিডিও ইতোমধ্যে গণমাধ্যমেও এসেছে।

নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা করার মাধ্যমে দেশবিরোধী এই উগ্র গোষ্ঠী মূলত দুইটি স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে। একইসাথে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে কলংকিত করা অপরদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে আটকিয়ে দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলা। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, এর আগেও নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে বাংলাদেশে এসেছেন, প্রায় তিনদিন বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন, কিন্তু তখন কোন প্রতিবাদ হয়নি, তখন কেউ রাস্তায় নেমে এমন অরাজকতা সৃষ্টি করেনি! তাহলে এই হঠাৎ মোদী বিরোধীতার কারণ কি! এই প্রশ্নের উত্তরে গেলেই পেয়ে যাবেন উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর আগমন বিরোধীতার মূল উদ্দেশ্য। মূলত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে যখন বাংলাদেশের দিকে চোখ দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্ব সম্প্রদায়ের তখন যদি নরেন্দ্র মোদীর আগমন নিয়ে সহিংস কার্যক্রম করা যায় তাহলে তা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই ধারণা থেকেই তারা নরেন্দ্র মোদীর এই ঐতিহাসিক সফরকে বেছে নেয়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যদি বাংলাদেশ কোন একটি দেশকেও আমন্ত্রণ জানায় তবে সেই দেশটি যে হবে ভারত সেব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ থাকবে বলে মনে হয়না। কারণ আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে যে দেশটি সার্বিক সহায়তা দিয়েছে সেটি হলো ভারত। এককোটি শরণার্থীকে আশ্রয়দান, নয় মাস নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো, যুদ্ধকালীন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দান থেকে শুরু করে সার্বিক সহায়তাই দিয়েছে ভারত। বলতে গেলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল কেন্দ্রই ছিলো ভারতে যেখান থেকে বুদ্ধি,পরামর্শ, অস্ত্র, কলাকৌশল সবকিছু আসতো। কিন্তু আমরা দেখলাম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যখনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো হলো সাথে সাথেই শুরু হলো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম। মূলত ২০০৯ সালের পর থেকে একের পর এক ঘটনা ও দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের সমাধান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে হাসিনা-মোদী সরকার। এই দুই নেতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বুঝাপড়ার কারণেই আজ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক সোনালী অধ্যায়ে রয়েছে। ২০২১ সালে সেই স্বর্ণালী অধ্যায়কে শেষ করে দিতে ওঠেপরে লেগেছিলো ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী। কিন্তু তারা সফল হন নি, নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে এসেছেন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে উপস্থিতও হয়েছেন। সকল ষড়যন্ত্রকারীদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কও চলেছে এগিয়ে।

নরেন্দ্র মোদীর সফর আটকাতে না পেরে নতুন ফন্দি আঁটছিল সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থীরা। অবশেষে অক্টোবর মাসে শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে তারা শুরু করলো নতুন সাম্প্রদায়িক আক্রমণ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক কালিমা দেয়ার উদ্দেশ্যে শুরু হলো মন্দির পূজোস্থলে আক্রমণ। হেফাজতে ইসলামের নেতারা সেই মন্দির হামলায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে। কুমিল্লায় এক মন্দিরে কোরআন শরিফ রেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সেই দায় চাপিয়ে আক্রমণের সূত্রপাত। তারপর একে একে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় মন্দিরে হামলা। হামলাকারীরা ক্ষুদ্র কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরিকল্পিত মিশনে নামেনি বরং তাদের লক্ষ্য ছিলো বৃহৎ  তারা চেয়েছিলো, এই হামলার সূত্রধরে ভারতের উগ্রপন্থীরাও মুসলমানদের ওপর হামলা চালাবে, এতে দুই দেশের সরকার পরবে বেকায়দায়, সম্পর্ক হবে নষ্ট। ভারতে মুসলমানদের ওপর হামলা হলে এই দেশে তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এটা বুঝাতে সক্ষম হবে যে, ভারত সরকার ইসলামবিরোধী! এবং এর মাধ্যমে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট গ্রো করে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের পাঁয়তারাও করছিলো এরা। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি! কারণ ঘটনার পরপরই ভারত সরকার বিবৃতির মাধ্যমে নিজের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে। তারা স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে,

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। যে হামলা হচ্ছে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের কী করা উচিত, এটা বলার জন্য আমরা এখানে আসিনি। দেশটা যখন আপনাদের, লোকজনের দেখভালের দায়িত্বটাও বাংলাদেশের। যেমনটা আমাদের লোকজনের দেখভালের দায়িত্ব ভারতের।

শুধু তাইনা, এক আলোচনায় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন,

যা ঘটেছিল, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। তবে আমরা লক্ষ করেছিলাম, লোকজন যাতে উৎসব পালন করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যা যা করা দরকার, তার সবটাই করেছিল। ফলে লোকজন দুর্গাপূজা পালন করতে পেরেছিলেন। বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের সরকার গ্রেপ্তার করেছিল। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা অবহিত রয়েছি এবং কোনো কিছু বলার বিষয়েও সতর্ক রয়েছি।

এ থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় এই সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ছেদ ফেলতে পারেনি। বাংলাদেশের আক্রমণের জের ধরে পশ্চিমবঙ্গেও এই হামলা হয় মুসলমানদের ওপর। তবে খুব দ্রুতই ভারত সরকার সেই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াতে দেয়নি। আইন শৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে সেই সহিংসতা মোকাবেলা করেছে এবং গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ার ভুয়া সংবাদ রুখে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। আমরা দেখেছি, ত্রিপুরায় মুসলমানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা নিয়ে প্রচুর মিথ্যা খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে দেখা গেছে খবরগুলো ঠিক নয়। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার দ্রুত এ বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য দিয়েছিল। এসব তথ্য ধর্মীয় নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সর্বত্র দেয়া হয়েছে এবং লোকজনকে আশ্বস্ত করানো গিয়েছে যে বাস্তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এভাবেই যারা সংবেদনশীলতা উসকে দিতে চায়, তাদের রোধ করতে হবে সকলে মিলে। যারা চায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তিক্ত করবে সেই অপশক্তিকে নির্মূল করতে হবে। (চলবে)

লেখক-হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat