×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০১-২৮
  • ৮২৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ২০২১ সালে নানামুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে কোনটাই দুই দেশের সরকার কর্তৃক সৃষ্ট কোন সমস্যা না। বরং দুই দেশের সরকারকে বিপাকে ফেলতে সর্বদা একটা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিরাজমান আর তারাই নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই লেখার প্রথম পর্বে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর সহিংসতা এবং দুই দেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম। এবারের লেখাতে আমরা একটু দৃষ্টি দেবো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত কয়েকটি বিষয়ের দিকে।

শুরুতেই আলোচনায় আনা যাক এনআরসি ইস্যুকে। ২০১৯ সালে এনআরসি ইস্যু ব্যাপক আকার ধারণ করলেও ২০২০ সালে আন্দোলনের সেই তীব্রতা কমেছে অনেকটাই। এনআরসি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কেও তখন কিছুটা অস্বস্তি আমরা দেখেছিলাম। সেই সময়টাতে এনআরসি ইস্যুসহ নানা বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে এক বন্ধনীতে রেখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বার বার উল্লেখ, ফের ভারত থেকে শরণার্থী যাওয়ার আশঙ্কা, শেখ হাসিনার ২০১৯ সালের কলকাতা সফরে কেন্দ্রের কোনও প্রতিনিধির না থাকা সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কিছুটা মন কষাকষি চলছিলো। তবে তাতে প্রলেপ লাগার কাজটা ২০২০ সালে করোনাকালীন ভারতের সহায়তার মাধ্যমেই শুরু হয়েছে। 'আঁধার ঘুচুক, পরশ থাকুক হৃদয় ভরা' এই স্লোগানকে ধারণ করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভারতের সহযোগিতা বন্ধুত্বের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভারতের সহযোগিতার অংশ হিসেবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট, জীবাণুমুক্ত সার্জিকাল ল্যাটেক্স গ্লাভস সমন্বিত জরুরি চিকিত্সা সেবা  বাংলাদেশে এসেছে। এরপর আসলো করোনা ভ্যাকসিন। সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মার চুক্তি এবং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ২০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিন উপহার হিসেবে পাঠানো ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বকে আরেকবার জানান দিয়েছে। যেখানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো টিকা পাচ্ছেনা সেখানে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ সর্বাগ্রে টিকা কূটনীতিতে বিজয়ী হয়েছে। তবে এনআরসি নিয়ে চর্চা বন্ধ হয়নি। এখনো অনেকের মনেই সেই প্রশ্নটা আছে যে, এনআরসি কার্যকর হলে কি নতুন কোন সমস্যা পড়বে বাংলাদেশ? এর উত্তর বরং শুনা যাক ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এর কাছ থেকে। গত কয়েকমাস আগে এক সাক্ষাৎকারে বিক্রম দোরাইস্বামী আবারো এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে। তিনি জানান,

নাগরিকপঞ্জির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টা নেই। কাজেই ডেটা সংগ্রহের মধ্য দিয়ে যে প্রক্রিয়াটি শেষ হয়েছে, সেটি এক ভিন্ন বিষয়। এখন নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, সেটা আইন এবং আদালতের নির্দেশনা মেনে সংসদ ঠিক করবে। তবে এতে বাংলাদেশে কোনো প্রভাব পড়বে না। যা কিছুই করা হোক, তা ভারতীয় আইন, নাগরিকত্ব আইন এবং আদালতের নির্দেশনার মধ্যেই সীমিত থাকবে। প্রক্রিয়াটির নিজস্ব কিছু জটিলতা রয়েছে, যা মূলত রাজনৈতিক ইস্যু এবং আমাদেরই এর সুরাহা করতে হবে।

এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ২০১৯ সালেও এক অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেন,

আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বার বার বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করেছে যে, এনআরসি এমন এক প্রক্রিয়া যা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণের উপর এর কোন প্রভাব পড়বে না। আমি নিশ্চিত করে আবারো এটা বলে যাচ্ছি।

আসামের এনআরসি নিয়ে বহু কথা হচ্ছে। বিভিন্ন ফোরামে অনেকেই আসামের অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, আবার বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানটি পরিষ্কার করেছে যে, বাংলাদেশ মনে করে আসামের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশি নয়। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যাপারে কোন রাজ্যের মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতারা কি বলেছে তা মুখ্য না। বরং গুরুত্ব দেয়া উচিত আজ নাগাদ এই এনআরসির ব্যাপারে কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে কিছু বলেছে কিনা সে ব্যাপারে! অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সরকার কখনো বাংলাদেশের কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলেনি এবং কোনো কূটনৈতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও এ বিষয়টি কখনো উঠে আসেনি। যেহেতু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ জানায়নি, তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারেনা।  বাংলাদেশের অনেক কলামিস্টের লেখা দেখে মনে হয়, অনিবন্ধিত মানুষরা বুঝি আজই বাংলাদেশে এসে উঠছে! কেউ কেউ আবার বলেছেন যে, দিল্লির উচিত ঢাকাকে আশ্বস্ত করা। কিন্তু আশ্বস্ত আর কি উপায়ে করা যায়? ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা  আশ্বস্ত করেছেন, গত কয়েকদিন আগে আবার আশ্বস্ত করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী, এরও আগে ক্ষুদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন এনআরসি নিয়ে! তাই এর চাইতে বেশি আশ্বস্তের কিছু দরকার আছে বলে আমার মনে হয়না!

ফেনী নদীর সীমানা চিহ্নিতকরণ বিষয়টির অনেক অগ্রগতি হয়েছে গতবছর অর্থাৎ ২০২০১ সালে। ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল সই হলেও ফেনী নদীর সীমানা চিহ্নিত করার বিষয়টির এখনো সমাধান হয়নি। ফেনী নদীর ওই ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার সীমানা সুরাহার জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে দুপক্ষের আলোচনা চলছে। দুই পক্ষই স্থল সীমান্ত চুক্তির নীতিমালা অনুসরণ করে সমস্যার সমাধানের বিষয়ে একমত আছে। কিন্তু সমস্যা একটু আছে আর তা হলো, নদীর সীমানা মাপার সময় নিয়ে। অতীতে যৌথভাবে নদীর পানি পরিমাপের পর সীমানা দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে নদীর গতিপথ বদলে গেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, নদীর কোন গতিপথকে বিবেচনায় নেওয়া হবে? বিষয়টির সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন বিক্রম দোরাইস্বামী, তিনি জানান,

এর সঙ্গে ভূমি ব্যবহারের বিষয়টি সরাসরি জড়িত। কোভিডের কারণে এতে দেরি হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত প্রক্রিয়াগুলো ত্বরান্বিত করে এর সুরাহা করতে পারব। রাজনৈতিক পর্যায় থেকে আমাদের এমন একটি সমাধান খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে, যাতে নতুন কোনো জটিলতা তৈরি না হয়। কাজেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করাটা এখন দুই পক্ষের জরিপকারী ও আমলাদের দায়িত্ব। কাজটিকে আমার অসম্ভব মনে হয়নি। নিজে দুবার সেখানে গিয়ে এবং মানচিত্র দেখে বুঝেছি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। স্থল সীমান্ত চুক্তির প্যাকেজের আওতায় আমাদের এর সমাধান করতে হবে।

সাম্প্রতিক ভারতের ঋণচুক্তি বা এলওসির আওতায় সর্বোচ্চ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। দুই পক্ষই বিষয়টি ত্বরান্বিত করতে চায়। এলওসির আওতায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৭৮০ কোটি ডলারের সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে; যা ভারতের বৈশ্বিক সহায়তার প্রায় ২৮ শতাংশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে যে শর্তে এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তার তুলনায় অনেক নমনীয় শর্তে তা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। ১ শতাংশ সুদে এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে ভালো শর্তে এই সহায়তা দেওয়ার সুযোগ অন্য কারও নেই বললেই চলে। বাজার থেকে ঋণ নিলে যে হার এবং ভারত যে হারে ঋণ দিচ্ছি, তার মাঝে যে তফাতটা থাকছে, সেটা ভারতই বহন করছে। কাজেই মূল টাকাটা যেহেতু ভারতই দিচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে ভারতের চাওয়া থাকবে প্রকল্প ত্বরান্বিত হোক, তা না হলে তো প্রকল্পের খরচ বাড়তে থাকবে। তবে এলওসির আওতায় থাকা প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে, সেটা দুই দেশই স্বীকার করেছে। এরই মধ্যে দুই পক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী কী সেটা নির্ধারণ করেছে। এলওসির আওতায় এখন পর্যন্ত ৬৯০ কোটি ডলারের ৪৩টি প্রকল্পের মধ্যে ১৪টি শেষ হয়েছে, ১৮টি বাস্তবায়নের পথে রয়েছে এবং ১১টির খসড়া প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) নিয়ে কাজ হচ্ছে। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করলে বলা যেতে পারে, প্রকল্পের মধ্যে ৭২ শতাংশ পরিকল্পনা বা ডিপিপি এবং দরপত্রের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ডিপিপির বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। তাই এখানে ভারতের বলার সুযোগ নেই কাজটি কিভাবে হওয়া উচিত। কিছু কিছু প্রকল্পের খসড়া প্রস্তাব তিন থেকে চার বছর আগের। ফলে ডিপিপি চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রকল্পের ব্যয় স্বাভাবিকভাবে আগের চেয়ে বেড়ে যায়। তবে গত বছর সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে চিহ্নিত হওয়ার পর কাজে গতি এসেছে। গত বছর পর্যন্ত ভারত প্রায় ৭০ কোটি ডলার খরচ করতে পেরেছে। ২০২১ সালে খরচ করেছে ১২ কোটি ডলার। তবে আশা করা হচ্ছে, দরপত্র এবং প্রকল্প বাস্তবায়নসহ খরচ ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এতে বাকি প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসবে। এলওসির কিছু প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে দরপত্র পর্যায়ে এলে প্রকল্পের কাজ সম্পূরকভাবে চলবে। ভারত সম্পূরক প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেবে, এক্সিম ব্যাংক দরপত্র প্রক্রিয়া, প্রকল্পের চুক্তি সই এবং প্রকল্পের শর্ত চূড়ান্ত করার মতো বিষয়গুলো একসঙ্গে করতে থাকবে। এখানে একটার পর অন্যটা করার প্রয়োজন নেই। জাপান এভাবে কাজ করে। ভারতও এখানে জাপানের প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করছে, এতে কাজ দ্রুত শেষ হয়। ২০২১ সালে এই  ঋণচুক্তির বিষয়টির অগ্রগতি আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমও সে মোতাবেক এগিয়ে চলছে। (চলবে)... 

লেখক--হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat