×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০২-২৬
  • ৮৫২ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

''যখন আমি দেখছি যে, পুরো এলাকাটাই একরকমের ডাস্টবিনের মতো হয়ে আছে। অনেক ময়লা। তখন এটাই আমার কাছে একটা ডাস্টবিন। সবকিছু যদি পরিস্কার থাকতো, তাহলে ময়লা ফেলতে হয়তো বিব্রত হতাম। আমরা তো ঘরে ময়লা ফেলি না। কারণ ঘর পরিস্কার থাকে। এখানে সবকিছু পরিস্কার রাখতে হবে, আলাদা ডাস্টবিন দিতে হবে।"

রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরতে আসা এক তরুণ ঝালমুড়ি খাওয়া শেষে কাগজের প্যাকেট ফুটপাতে ফেলার পর তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, কেন তিনি এমনটা করলেন; তখন তার জবাব ছিলো এটি। মূলত ঢাকা শহরের অপরিচ্ছন্নতা এবং বসবাসের যোগ্যতা অযোগ্যতা নিয়ে বহু আগে থেকেই আলোচনা সমালোচনা চলছিলো। যে তরুণ উপরোক্ত বক্তব্যটি দিয়েছে সেটাকে অস্বীকারের যেমন উপায় নেই আবার মুদ্রার উল্টো পিঠও যে রয়েছে  তাও স্বীকার করতে হবে। কেননা এই সিটিতেই বিভিন্ন স্পটে, মোড়ে মোড়ে ডাস্টবিন বসানো হয়েছিলো সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগেই। কিন্তু অনেক জায়গাতে রাস্তার পাশে ডাস্টবিন থাকলেও তা ব্যবহার হচ্ছে না। বিনের পাশেই আছে ময়লার স্তুপ। কোথাও কোথাও খোদ ময়লা ফেলার বিনটিও চুরি হয়ে গেছে। অনেক স্থানে আবার ডাস্টবিন উল্টো করে বেঁধে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। তার মানে নাগরিক হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব সেটা পালনে আমাদেরর ঘাটতিও আছে। তাই একতরফা তরুণের এই বক্তব্যকে সমর্থনও করা যায়না। কেননা এতো বড় শহরে নিশ্চয়ই প্রত্যেকটি  ডাস্টবিন পাহারা দেয়ার মতো লোকবল নিয়োগ দেয়া হবে না! আমার জানা নেই,  বিশ্বের কোথাও ডাস্টবিন পাহারা দিতে লোকবল নিয়োগ দেয়া হয় কিনা! এখানে নাগরিকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।

উপরোক্ত ঘটনাটি আনার পেছনে মূল কারণ হলো আমাদের শহরের পরিচ্ছন্নতার জায়গাকে গুরুত্ব দেয়া। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে ধূলাবালি আর ময়লা আবর্জনার স্তূপ যেনো স্বাভাবিক জীবন যাপনের অংশ হয়ে গিয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বা নাগরিক উদ্যোগ নেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত না। অনেক সময় প্রতীকী পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি হয়, অসংখ্য উদ্যমী মানুষ এতে অংশ নেয়, জনসচেতনতা মূলক ক্যাম্পেইন হয় কিন্তু দিনশেষে কার্যকরী সিদ্ধান্তে যাওয়া যায়না বলেই এই সমস্যার সমাধান আদৌ হচ্ছে না। এবার ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে বাংলাদেশের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সর্বোত্তম অনুশীলনগুলি ভাগ করে নেওয়ার জন্য ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে ভারতের ইন্দোরের ও ঢাকা উত্তরের সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে একটি ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওয়েবিনার আয়োজনে সহায়তা করেছে ভারতীয় হাই কমিশন এবং ভারত সরকারের আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাথে ইন্দোরের এই আলোচনা সভা কেন কার্যকরী তা বুঝতে হলে আমাদেরকে সবার আগে জানতে হবে ইন্দোর সম্পর্কে। মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের জেলা ও বিভাগ ইন্দোরে প্রায় ২৩-২৪ লাখ লোকের বাস। একদা রাজ্যের রাজধানী ছিল। শিক্ষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে অতুলনীয়। প্রস্থর যুগ থেকে এই নগরের কথা জানা যায়। মুঘলদের প্রতাপ ছিল এখানে। হোলকার সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুবেদার মালহার রাও হোলকার। সতেরশ শতকের মাঝামাঝি। অল্প বয়সে বিধবা হওয়া পুত্রবধূ আহিলিয়া বাইকে রাজশাসনের জন্য তৈরি করেছিলেন। মালহার মহারাজের হোলকারের মৃত্যুর পর ১৭৬৭ থেকে ১৭৯৫ পর্যন্ত আহিলিয়া বাইয়ের শাসনকাল। ইন্দোরের প্রায় সবকিছুর সঙ্গে এখনো মিলেমিশে একাকার মহারানী আহিলিয়া বাই। ইন্দোর শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হোলকারদের কীর্তিময় ইতিহাস। শিল্পকলা। সৃষ্টি। স্থাপত্য। ১৮১৮ পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজ থেকে স্বাধীন ছিল রাজ্যটা। মারাঠা সাম্রাজ্যে তাদের জন্ম, তাদের সঙ্গে মিলে লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু বরাবর স্বাধীনচেতা হোলকাররা। তারও আগে মালহার রাও হোলকার নামের যে সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন সেটি পূর্ণতা পেয়েছিল আহিলিয়া বাইয়ের শাসনামলে। এখন প্রায় তিনশ বছরের আজ হোলকার ইতিহাস

২০২১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পরিচালিত বার্ষিক পরিচ্ছন্নতা সমীক্ষায় ঐতিহাসিক এই ইন্দোর শহরকে দেশটির সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রকের দ্বারা আয়োজিত 'স্বচ্ছ অমৃত মহোৎসব' অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দ মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরকে এদিন 'স্বচ্ছতা কা তাজ'-এর মুকুট পরালেন। স্বচ্ছ সর্বেক্ষণ হল দেশের সব শহরগুলির পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশনের একটি বার্ষিক সমীক্ষা। এটি কেন্দ্রের স্বচ্ছ ভারত অভিযানের অংশ হিসাবে চালু করা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ভারতকে পরিষ্কার করা এবং খোলা জায়গায় মলত্যাগ বন্ধ করা। স্বচ্ছ সার্বেক্ষণ ২০২১-এ মোট ৪ হাজার ৩২০টি শহরে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এই এই সমীক্ষার ষষ্ঠ সংস্করণ। এটি বিশ্বের বৃহত্তম নগর পরিচ্ছন্নতা সমীক্ষায় পরিণত হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশংসনীয় পদ্ধতির কারণে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের এ শহরটি ২০১৭ সাল থেকে টানা পাঁচবার এ স্বীকৃতি অর্জন করেছে। অর্থাৎ ইন্দোর আমাদের এই উপমহাদেশের পরিচ্ছন্ন নগরীর একটা। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কি ধরণের পদ্ধতি ইন্দোর অবলম্বন করে তা জানা এবং ঢাকা শহরে সে অনুযায়ী কাজ করলে বর্তমান অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।

গত ৮ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিতব্য ওয়েবিনারে ইন্দোর মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের কর্মকর্তারা বর্জ্য সংগ্রহের পদ্ধতি, উদ্ভাবনী অনুশীলন এবং দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের দ্বারা গৃহীত প্রযুক্তি নিয়ে কথা বলেছেন। ইন্দোর মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন শতভাগ ঘরে ঘরে গিয়ে বিচ্ছিন্ন বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা, ক্লিনারদের জন্য বায়োমেট্রিক উপস্থিতি ব্যবস্থা, জিপিএস-ট্র্যাক করা যায় এমন বর্জ্য সংগ্রহের যানবাহন ইত্যাদির বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। ডিএনসিসি কর্মকর্তারা তাদের সর্বোত্তম অনুশীলনগুলোর বিষয়ে এবং কীভাবে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পৌরপরিষেবার ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়া যায় সে সম্পর্কে ফলপ্রসূ আলোচনা করেন। ভারতের পক্ষে ওয়েবিনারে যুক্ত ছিলেন জাতীয় মিশন পরিচালক ও ভারত মিশনের যুগ্ম সচিব রূপা মিশ্র, ইন্দোর মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের অতিরিক্ত কমিশনার সন্দীপসোনি, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনাকারী করপোরেশনের কর্মকর্তারা এবং সেন্ট্রাল পাবলিক হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্গানাইজেশনের প্রতিনিধিরা। ডিএনসিসির অতিরিক্ত সচিব ও প্রধান নির্বাহী মো. সেলিম রেজা বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। প্রতিনিধিদলে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আমিরুল ইসলাম, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এসএম শরীফ-উল ইসলাম এবং ডিএনসিসির অন্য সদস্যরা যুক্ত ছিলেন।

ঢাকা শহরে বর্জ্য পৃথকীকরণ পদ্ধতি কি উপায়ে প্রয়োগ করা যায়, ঘরে ঘরে গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের বিষয়টি কিভাবে আরো ফলপ্রসূ করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। বাসিন্দাদের দ্বারা বাড়িতে কম্পোস্টিং, দিনের বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, নগর কর্তৃক কম্পোস্টিং সুবিধা ইত্যাদি ব্যাপক আকারে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিভাবে চালু করতে পারে তা নিয়ে আমাদের বিস্তর আলোচনার জায়গা আছে আবার নগরবাসীর মধ্যে শহরের প্রতি ভালবাসা, নাগরিক দায়বোধ এবং পরিচ্ছন্নতার জন্য জনসচেতনতা তৈরিতে যে ধরণের সামগ্রিক উদ্যোগ দরকার তার ঘাটতিও পূরণ করতে হবে। এখানে প্রণোদনা এবং শাস্তি দুটোই দরকার কিনা তাও ভাবা যেতে পারে, মানে যারা শহরকে নোংরা করছেন, ময়লা ফেলছেন তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা যায় কিনা! আর যারা পরিচ্ছন্নতার জন্য বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখছে তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যায় কিনা! এ দুটোর মিশ্রণে অনুশাসন তৈরির ব্যাপারটা কতোটুকু কার্যকর হবে সেটাও ভেবে দেখতে হবেআবার কেউ রাস্তায় আবর্জনা বা ময়লা ফেললে তাকে দণ্ড বা জরিমানা করার মতো ক্যাপাসিটি আমাদের আছে কিনা, সমাজ এখনো এরজন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেছে কিনা তাও আমাদের মাথায় আনতে হবে। আবার এটাও সত্য যে, জরিমানা বা দণ্ডের বিধানে না গিয়ে সবার আগে জোর দিতে হবে আমাদের নিজেদের অর্থাৎ নাগরিকদের সচেতন করার উপর। এরজন্য নানা প্রচার অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যে দায়িত্ব তাও পালন করতে হবে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ভারত সরকার ইন্দোরের মাধ্যমে যে সহায়তার পরিকল্পনা করেছে তাকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা চাই, ভারতের ইন্দোরের মতোই পরিচ্ছন এক শহর হোক আমাদের ঢাকা।

লেখক-হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। 


 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat