×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৫-২৬
  • ১১৪৪ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

গগনবিদারী মেঘের গর্জন, ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ প্রকৃতির মাঝেই সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী এক নেতার আগমন ঘটে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে। নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে যে নেতা নিঃস্ব একা কুর্মিটোলাতে পা রাখলেন তিনি হয়তো জানতেনই না এই দেশ, দেশের মানুষ তার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকার তৎকালীন কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে লাখো জনতা সেদিন একনজর দেখার জন্য জড়ো হয়েছিলেন কুর্মিটোলায়। সেদিনকার কুর্মিটোলার রূপ ছিল আবেগ ভালবাসা, দ্রোহ, সংগ্রামে পরিপূর্ণ। ১৭ মে দিনটি ছিলো রবিবার, দুপুর থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। দুপরের আগে থেকেই বিমানবন্দর থেকে শুরু করে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে মানুষের ভিড় ছিল। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর সাড়ে ৪টায় সত্যিই যখন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭৩৭ বোয়িংটি আকাশে দেখা গেল, তখন সব শৃঙ্খল ভেঙে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় বিমানটিকে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। সবমিলিয়ে সে সময় পুরো বিমানবন্দর এলাকা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। বলা হয়ে থাকে, বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব, শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ভারতের নাম, বিশেষ করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নাম। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে দিল্লীর নির্বাসিত জীবনকে স্মরণ করতেই হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা উঠলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, দিল্লীতে থাকা অবস্থায় ভারত সরকার কি ধরণের সহায়তা দিয়েছেন সে বিষয়ে অনর্গল বলতে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে, রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসভবনে। সেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে আরো ছিলেন তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া এবং দুই শিশুসন্তান, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের খবরটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের কাছে আসে পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সানাউল হকের বাসায় ফোন দিয়ে জানান এই দুঃসহ সংবাদ। পরবর্তীতে ব্রাসেলস থেকে শেখ হাসিনারা চলে যান বনে রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর বাসভবনে। সেখান থেকেই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে তারা নিশ্চিন হন বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে। ৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকেই রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী শুরু করেন গোপন তৎপরতা; বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত কন্যাকে কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিয়ে দেয়া যায় কি না। এ বিষয়টি দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, এবং দুদিন পরই তারা বলে, শিগগিরই যেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লিতে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়। ভারতীয় কর্মকর্তাদের তরফ থেকে আরো বলা হয়, গোটা বিষয়টি যেন খুব গোপনে ও দ্রুত সম্পন্ন করা হয়, এবং শেখ হাসিনাদের যেন এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে সরাসরি দিল্লিতে পাঠানো হয়। এভাবেই শেখ হাসিনারা ২৪ আগস্ট বিকেলের দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন, এবং ২৫ আগস্ট খুব ভোরে তারা দিল্লিতে পৌঁছান। এর মাধ্যমে শুরু হয় শেখ হাসিনার পৌনে ছয় বছরের দিল্লি জীবন।

শেখ হাসিনা যখন ভারতে আসেন তখন দিল্লির রাজনীতিতেও টালমাটাল সময়। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। তারপর ইন্দিরার পতন এবং জনতা দলের সরকার গঠন। কিছুদিনের মধ্যেই জনতা দল সরকারের পতন এবং ইন্দিরার প্রত্যাবর্তন। এ সবই শেখ হাসিনার চোখের সামনে হয়েছে। কিন্তু এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও ভারত সরকার শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে সর্বোচ্চ যত্ন নিয়েছে, দিয়েছে নিরাপত্তা। দিল্লিবাসের অধিকাংশ সময়টা শেখ হাসিনা ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্ক এলাকায় ছিলেন। শেখ হাসিনাদের প্রথমে রাখা হয় ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি 'সেফ হাউজ'-এ। পরে তাদেরকে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং তাদের প্রতি তিনটি পরামর্শ দেয়া হয়। প্রথমত, তারা যেন বাড়ির বাইরে না যান; দ্বিতীয়ত, তারা যেন সেখানে কারো কাছে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় না দেন; তৃতীয়, দিল্লিতে কারো সঙ্গে যেন যোগাযোগ না রাখেন। দিন দশেক পরে, ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের একজন সরকারি কর্মকর্তা শেখ হাসিনাদের নিয়ে যান ইন্দিরা গান্ধীর সরকারি বাসভবন, ১ সফদরজং রোডের বাসায়। এরও আরো দশদিন পর তাদেরকে পান্ডারা পার্কের সি ব্লকের একটি ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। ওই ফ্ল্যাটে তিনটি শোবার ঘর আর কিছু আসবাব ছিল। খবর দেখার জন্য একটি সাদাকালো টেলিভিশন সেটও দেওয়া হয়। তখন ভারতের টেলিভিশনে শুধু দুই ঘণ্টার জন্য দূরদর্শনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে দিন কাটত তাদের। বাড়ির আশপাশে ছিল নিরাপত্তার কড়া বেষ্টনী। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তাদের ভয় ছিল শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে। তাই নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দাদের নজরও থাকত সেখানে।

শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, তাঁর দেখভালের দায়িত্ব ইন্দিরা গান্ধী দিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। তখন থেকেই হাসিনার সঙ্গে প্রণববাবুর খুবই হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রণববাবু ছিলেন শেখ হাসিনার অভিভাবকের মতো। প্রণববাবু তো শেখ হাসিনাকে তাঁর বড় মেয়ে বলে মনে করেন। প্রণববাবুর ছেলে অভিজিতের সঙ্গে হাসিনার ছেলে জয়ের, শেখ রেহানার সঙ্গে প্রণববাবুর মেয়ে শর্মিষ্ঠার ভাল সম্পর্ক। প্রণববাবুর স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে শুভ্রা মুখোপাধ্যায় যখন মারা যান, তখন শেখ হাসিনা প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে দিল্লি এসেছিলেন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, দিল্লিবাসের সিংহভাগ সময়ই রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন শেখ হাসিনা। এর কারণ সম্ভবত এই যে, তখন ভারতেও চলছিল জরুরি অবস্থা। তাই নিজ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যতই শোচনীয় হোক না কেন, ভারত সরকারের নির্দেশে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নিতে পারেননি। তবে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা নিয়মিতই শেখ হাসিনার বাড়িতে যেতেন এবং চেষ্টা করতেন তাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য রাজি করাতে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার চেষ্টা করতে থাকেন শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য, যেন তিনি তাদেরকে নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কারণে শেখ মুজিবের পরিবারের অবশিষ্ট কারোই বাংলাদেশে প্রবেশ সম্ভব ছিল না। তারপরও ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

১৯৮১ সালে বাংলাদেশের রাজনীতি বিভ্রান্তিকর ও পথহারা ছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল অনেকটাই নেতৃত্ব শূন্য। জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো। তারা আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে নানাবিধ গুজব ও প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকে। এই গুজবের প্রচারণা এখনো চলছে। আওয়ামীলীগের পক্ষে এসব প্রতিহত করে রাজনীতির মাঠে দাঁড়ানো সহজ কাজ ছিল না। আর তাই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের দায়িত্ব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ও বিদ্যুৎ যোগাযোগসহ সর্বক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী মাদার অব হিউমিনিটি উপাধি পেয়েছেন। বিভিন্ন ইতিবাচক কাজের জন্য পেয়েছেন প্রচুর প্রশংসা ও উপাধি। তার নেতৃত্বে জাতির পিতার খুনি ও একাত্তরের নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর হয়েছে। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে এক সময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করত সেই দেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনার দিল্লিতে কাটানো পৌনে ছয় বছরের বিশেষ গুরুত্ব হলো, ওই সময়টাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন নিজের মন শক্ত করতে, এবং দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে। দিল্লীর নির্বাসিত জীবন থেকে নিজে যে শিক্ষা নিয়েছেন তাই আজকের শেখ হাসিনা হতে সহায়তা করেছে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি যে মানসিকভাবে শক্তিশালী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজ স্বদেশ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, এবং পরবর্তীতে ধরেছেন বাংলাদেশের হাল, সেই অধ্যায়ের ভিত রচিত হয় তার পৌনে ছয় বছরের দিল্লি জীবনেই।

লেখক--হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat