×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-১৮
  • ৫৭৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

একটি সেতু, একটি স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। তবে এখন আর সেই সেতু স্বপ্নের নয় বরং বাস্তব। আর এই স্বপ্ন বাস্তবের খুশি শুধু বাংলাদেশ নয়, সীমানা পেড়িয়ে পৌঁছে গেছে ওপার বাংলায়। পদ্মা সেতুর লাইভ উদ্বোধন দেখানো হয়েছে কলকাতার আট পয়েন্টে। পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকার এবং কলকাতা পৌরসভা এমন আয়োজন করেছে শহর কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে। বাংলাদেশের পাশাপাশি কলকাতার মানুষের আবেগকে সম্মান জানাতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানায় কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ দূতাবাস। মোট ৫টি ডিজিটাল ও ৩টি এনালগ বিলবোর্ডে ভেসে উঠে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের লাইভ ভিডিও এবং আপডেট। কলকাতার পার্ক সার্কাস ৭ পয়েন্ট ক্রসিং, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ১ নাম্বার গেট, ধর্মতলার ভিক্টোরিয়া ওয়াই চ্যানেলের সামনে এবং এলগিন রোডে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেরদিন থেকেই কলকাতা পৌরসভার ডিজিটাল বিলবোর্ডগুলোতে ভেসে উঠে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রস্তুতির সব ছবি। তাছাড়া পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে উদযাপন করা হয়েছে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের প্রাঙ্গণেও। উদ্বোধনের দিন শত শত মানুষ ভিড় জমায় সেই পয়েন্টগুলোতে যেখানে কলকাতা প্রশাসন লাইভ উদ্বোধন দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলো। একটি সেতুর আনন্দ দুই দেশকে ছুঁয়ে যেতে পারে এবং এর বিশেষ একটা কারণও রয়েছে। কারণ এই পদ্মা সেতুর সাথে জড়িয়ে আছে ঢাকা-কলকাতার নাড়ির সংযোগ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সাথে সাথেই কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্ব দেড়শো কিলোমিটার কমেছে! আগে এপার বাংলার রাজধানী থেকে ওপার বাংলার রাজধানীতে পৌঁছতে ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে হত। জুন মাসের ২৫ তারিখ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এখন ঢাকা থেকে কলকাতা ২৫০ কিলোমিটার গেলেই চলবে।

সুকুমার রায়ের হযবরল গল্পে কাকটি যে হিসাব দিয়েছিল তাতে মাত্র দেড় ঘণ্টায় কলকাতা থেকে তিব্বত পৌঁছে যাওয়া যায়। কলকাতা, রানাঘাট, ডায়মন্ড হারবার, তিব্বত। ব্যাস! সে তো গল্পের হিসেব। কতকটা তেমনটাই ঘটতে চলেছে। এবার ঢাকা থেকে আসা যাবে কলকাতা, সময় লাগবে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই হতে চলেছে। এর জন্য আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। সড়কপথে এখন ঢাকা থেকে কলকাতার দূরত্ব ২৫০ কিলোতে নেমে এসেছে। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প চালুর পর ঢাকা-কলকাতার যোগাযোগে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। সিটি অফ জয় খ্যাত কলকাতা শহরটি বাংলাদেশীদের কাছে ব্যাপক পরিচিত এবং শুধুমাত্র ঈদ শপিং করতে প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ বাংলাদেশীর আগমন ঘটে কলকাতা শহরে। এছাড়াও রয়েছে চিকিৎসা ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এই শহরে যাওয়া। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ক্ষেত্রে এই কলকাতা উপমহাদেশের সংস্কৃতি মনা মানুষদের এক তীর্থস্থান। বিশেষ করে বাঙালি সংস্কৃতির এক আধার এই সিটি অফ জয়। প্রতিদিন গড়ে ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচল করে ছয়টি পরিবহনের ৩০টি যাত্রীবাহী বাস। এসব যানবাহনে প্রতিদিন গড়ে যাতায়াত করেন প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি ও ভারতীয় পর্যটক। এদের কেউ চিকিৎসা নিতে যান, কেউ ব্যবসা ও বেড়ানোর কাজে। তাই দশ ঘন্টার ভ্রমণের পরিবর্তে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টায় কলকাতা যাবার সংবাদটি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য এক আলাদা আনন্দবার্তা নিয়ে এসেছে।

বর্তমানে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা থেকে সরাসরি কলকাতায় যাওয়া যায়। কলকাতা স্টেশন থেকে নদীয়া হয়ে গেদে এবং গেদে হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত স্টেশন দর্শনা পার হয়ে ঢাকায় অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছায় মৈত্রী এক্সপ্রেস। এ রুটে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার রেলপথ পাড়ি দিতে হয় যাতে সময় লাগে প্রায় দশ ঘন্টা। ২০২৪ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর রেলের নির্মাণকাজ শেষ হতে যাচ্ছে আর তখন কলকাতা স্টেশন থেকে বনগাঁ জংশন হয়ে হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বেনাপোল হয়ে যশোর, নড়াইল, ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে ঢাকা পৌঁছতে পারবে ট্রেনটি। এ রুটের দূরত্ব দাঁড়াবে প্রায় ২৫১ কিলোমিটার। যা পার করতে মৈত্রী এক্সপ্রেসের গতিতে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। অপরদিকে সড়ক পথে ঢাকা-কলকাতা যেতে প্রায় সারাদিন লেগে যায়। দূরত্ব তো আছেই, সঙ্গে পদ্মাতীরে ফেরির জন্য দীর্ঘ লাইনের অপেক্ষা। সেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে এখন। পদ্মা নদীর ওপর তৈরি হয়েছে বহুকাঙ্ক্ষি সেতু। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ২৫ জুনে চালু হয়েছে এ সেতু। তবে সেতুর ওপর দিয়ে পুরোপুরি রেলসংযোগ পেতে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।  রেলসেতু ও রেলপথ নির্মাণের পর ঢাকা-কলকাতা যোগাযোগে অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটবে। সড়কপথে যেমন দূরত্ব কমে আসবে এবং সময় বাঁচবে তেমনি দশ ঘন্টার পথ রেলে যাওয়া যাবে মাত্র সাড়ে তিনঘন্টায় অর্থাৎ এটি চালু হলে ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় দুই-তৃতীয়াংশ কমে আসবে। এছাড়া রেলপথে কলকাতা থেকে আগরতলা যেতে সময় লাগে ৩০ ঘণ্টা। সেই সময়ও কমে আসতে পারে ছয় ঘণ্টায়। পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে এ রুটেও রেল পরিষেবা চালু হবে।

বাণিজ্যিক লাভের আশাবাদী ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে ভোগান্তি কমবে যাত্রীদেরও। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে গাড়ির দীর্ঘ লাইন, প্রতিকূল আবহাওয়া, ফেরিতে ওঠার বিড়ম্বনা সব মিলেয়ে যাত্রীরা পরিত্রাণ পাবে এমন হয়রানি থেকে। পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে একবারে সরাসরি বেনাপোল ইমিগ্রেশনে- এমন স্বপ্ন দেখছেন ভারতগামীরা। এক পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার বাংলাদেশি পর্যটক ভারতে প্রবেশ করেন। যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই থাকেন কলকাতায়। পদ্মা সেতু চালুর ফলে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে যাতায়াতে সময় বাঁচলো প্রায় ৪ ঘণ্টা। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, কলকাতায় আসা বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যাও এখন দ্বিগুণ হবে। পরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-কলকাতা যাতায়াত করা বাসগুলো পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরী ঘাট রুট ব্যবহার করে থাকে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে এই বাসগুলোকে আপাতত এই রুটেই ব্যবহার করতে হবে। কারণ এই রুটের পারমিট নেওয়া। তবে ঢাকা-খুলনা-কলকাতার বাস পদ্মা সেতু হয়ে যাতায়াত করবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) অনুমতি নিয়ে শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস ঢাকা-কলকাতা রুটে সরাসরি পরিচালনা করে থাকে। এদিকে পদ্মা সেতুর রেললাইন চালু হলে ট্রেন চলাচলেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। কারণ পদ্মা সেতুর ওপরের তল দিয়ে চলবে যানবাহন। নীচের তল দিয়ে চলবে ট্রেন। রেলপথের কাজ শেষ হলেই এই পথ দিয়ে চলাচল করবে ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস। আর মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে ঢাকা থেকে রেলপথে কলকাতা পৌঁছতে। আর এতোসব কারণেই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে ঢাকা কলকাতায় এত আনন্দ উত্তেজনা।

শুধু বাংলাদেশই নয়, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে লাভবান হবে কলকাতার মানুষও। নিজ দেশের যোগাযোগ বন্ধন শুধু নয়, ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সেতুবন্ধন হিসেবে বড় ভূমিকা রাখবে এ সেতু। পাশাপাশি উপমহাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। এমনটাই মনে করছেন ভারতের ব্যবসায়িক সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনরা। বৃহস্পতিবার (২৬ মে) কলকাতায় দিনব্যাপী ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর বিষয়টি আলোচিত হয়। সময় টিভির কলকাতা প্রতিনিধি সুব্রত আচার্য প্রেরিত পদ্মা সেতুর জন্য মুখিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় এ সব তথ্য। সুব্রত আচার্য লিখেছেন,

২০১৪ সালের নভেম্বরে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখন অপেক্ষা স্বপ্ন ডানা মেলার। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াবাসীই শুধু নয়, পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন নিয়ে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা আসছে ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতাদের আলোচনায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়,

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের বড় অর্জন। আর এ অর্জনকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টাকে অভিনন্দন জানাতে চান পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও। অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি বড় উন্নয়নশীল দেশ। বিপুল জনসংখ্যা নিয়েও বাংলাদেশকে যে উনি (শেখ হাসিনা) এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন, এজন্য ওনাকে ধন্যবাদ।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে যখন রূপ নিলো তখন ঢাকা-কলকাতার দূরত্বটাও গেলো কমে। বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাস আনন্দের পাশাপাশি কলকাতার মানুষের আনন্দ উদ্দীপনাও ছিলো দেখার মতো। একটি সেতু কিভাবে দুই দেশের মানুষের মাঝে আনন্দধারা বইয়ে দিতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সাথে ভারতে যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন পরিধি রচিত হবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে।

লেখক-হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat