×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-২৪
  • ৫২১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এই সম্প্রদায়ের জন্য সব থেকে বড় অর্জন হিসেবে ধরা হচ্ছে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সাঁওতাল কন্যা দ্রৌপদী মুর্মুর বিজয়। শুধু সাঁওতাল বললে ভুল হবে বরং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যও দ্রৌপদী মুর্মু এখন এক আলোকবর্তিকা। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি জোট মূলত চমক সৃষ্টি করে গত ২১ জুন প্রার্থী হিসেবে এক সাঁওতাল নারীর নাম ঘোষণা করে। ভোটের সমীকরণে স্পষ্টতই দ্রৌপদী মুর্মু এগিয়ে ছিলেন এবং ১৮ জুলাই ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটের পর তিনি যে জয়লাভ করতে যাচ্ছেন তা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। অবশেষে ২১ জুলাই আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, দ্রৌপদী মুর্মু ইতিহাস সৃষ্ট করে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। কোন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারী হিসেবে প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছেন দ্রৌপদী মুর্মু। একজন সাঁওতাল নারীকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) পরিবার যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে, এই স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। রাজনীতিতে উঁচু নীচু ভেদাভেদের বাইরে গিয়ে সাম্য ও সমতার বার্তা দেয়াটা খুব জরুরি। যেকোন রাজনৈতিক দল নিজেদেরকে এই পরিচয়ে পরিচিত করতে চায়। এমনকি এই পরিচয় গৌরব করার মতো। আর সেদিক থেকে বলাই যায় দ্রৌপদী মুর্মুর এই বিজয় সামনের দিনে বিজেপির জন্য আরো প্রশস্ত রাস্তা খুলে দিয়েছে, বিজেপিকে জনতার কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এই মনোনয়ন বেশ কাজে দেবে। আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের জনসংযোগে বিজেপির এই মনোনয়ন অনেক রাজ্যে এগিয়ে রাখবে তাদের। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ এ বিষয়ে কিছু প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমাজ ঠিক কী পাবে? দ্রৌপদী মুর্মু কি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতীক? নাকি, এই মনোনয়নের বাড়তি কোনো রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে?

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা আদিবাসীদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে তাদের জাতিগত পরিচয় স্বীকৃতির প্রশ্নে এখনো তারা লড়াই করছেন। সাংবিধানিকভাবে অনেক দেশেই তাদের জাতিসত্বার স্বীকৃতি মেলেনি। বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে না বরং ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী হিসেবে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত জনগণকে উপজাতি বলে সম্বোধন বিলুপ্ত করে ক্ষুদ্রনৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসাবে অভিহিত করার বিধান সংসদে পাস হয়। তবে কোনো জাতিগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র বলে সম্বোধন করার যৌক্তিকতা নিয়ে যথেষ্ঠ প্রশ্ন রয়েছে। এরকম প্রায় প্রতিটি দেশেই তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতিতে সমস্যা আছে, পুরোনো বসতিতে তাদের সংখ্যালঘু করে তোলা হচ্ছে, কোন কোন দেশে তারা সরকার কর্তৃক চরম নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। আর এমন অবস্থায় বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ, এশিয়ার এক অন্যতম পরাশক্তি ভারতে যখন একজন সাঁওতাল কন্যা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয় তখন তা ভিন্ন আশা জাগায় বৈকী! সাঁওতাল এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত তবে এই ভূখন্ডের প্রশ্নে সাঁওতালরা ইতিহাসে একটু আলাদা গুরুত্ব বহন করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ১৮৫৫ সালের সশস্ত্র হুল বিদ্রোহের জন্য সাঁওতালরা ইতিহাস বইয়ে বিশেষভাবে সুপরিচিত। হুল বিদ্রোহ হলো ১৯ শতকে ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত একটি ঔপনিবেশিক ও জমিদারি শাসন-বিরোধী আন্দোলন, যাকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়েছিলো। এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। ইতিহাসে বিশেষভাবে স্থান করে নেয়া সাঁওতালরা বর্তমানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টীর একটি। ভারতে একদিকে যখন সাঁওতাল কন্যা দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হলেন অন্যদিকে সেই জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে পরার দৃশ্য চলমান। তাই সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বা অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এখন হয়তো কিছুটা আশায় বুক বাঁধবে। নিজেদের দুঃখ কষ্টের কথা উচ্চস্বরে বলার মতো সাহস পাবে, নিজেদের কমিউনিটিকে এখন হয়ত আরো শক্তভাবে ধরে রেখে দাবি আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে পারবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্রৌপদী মুর্মু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষকে সাহসী করে তুলবেন।

 

ওড়িশার ময়ূরভাঁজ জেলার বায়দাপোসি গ্রামে ১৯৫৮ সালের ২০ জুন জন্ম দ্রৌপদীর। গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের এ মেয়ে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশোনা করেন রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরের রমাদেবী উইমেনস কলেজে। ক্যারিয়ার শুরু করেন ওড়িশা সরকারের করণিক হিসেবে। দ্রৌপদী নিজেকে গরীবের মধ্যেও গরীর পরিবারের সন্তান বলে দাবী করেন। দাদীর অনুপ্রেরণায় লেখাপড়া শেষ করে রাজ্য সরকারের তৃতীয় শ্রেণীর চাকরিতে ঢোকেন পরিবারকে আর্থিক সহায়তার উদ্দেশ্যে। বিয়ের পর সন্তানকে বড় করার লক্ষ্যে সে চাকরি ছাড়তে হয়। কিন্তু সংসারের কাজ করে দিনের অফুরন্ত সময় কর্মহীন থাকতে হতো। এই সময়কে কাজে লাগাতে বিনা বেতনে স্কুলে পড়ানো শুরু করেন। পাশাপাশি যুক্ত হন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। এসব কর্মকাণ্ডে এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি পান, সাথে প্রশংসাও। দাবি ওঠে রাজনীতিতে যুক্ত হবার। স্বামীর অনুপ্রেরণায় তাতেও নাম লেখান। এভাবেই সরকারী কর্মী থেকে রাজনীতিতে যোগদান এবং আজ প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারতের ইতিহাসে স্থান করে নিলেন দ্রৌপদী মুর্মু।

ঝাড়খন্ডের প্রথম নারী গভর্নর দ্রৌপদী মুর্মুর রাজনীতি শুরু হয় একজন কাউন্সিলর হিসেবে। দ্রৌপদী মুর্মু ১৯৯৭ সালে রায়রাংপুর নগর পঞ্চায়েতের কাউন্সিলর হয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ওডিশা থেকে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে দুই মেয়াদে আইনপ্রণেতা ছিলেন তিনি। বিজেপির সমর্থন নিয়ে রাজ্যে সরকার গঠন করা বিজু জনতা দলের (বিজেডি) মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু। প্রথমে আদিবাসী কোটায় কাউন্সিলর, তারপর উপদেষ্টা, সাংসদ, রাজ্য মন্ত্রী থেকে রাজ্যপাল। অর্থাৎ, রাজ্যের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে সেই রাজ্যের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ রাজ্যপাল! আর তারপর রাষ্ট্রপতি! ভারতে এই প্রথমবার একজন কাউন্সিলর রাষ্ট্রপতি পদে পৌঁছতে পেরেছেন এবং এটি ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড।

দ্রৌপদী মুর্মুর পারিবারিক জীবন কাহিনী অনেকটাই কষ্টের। তার বিয়ে হয়েছিল শ্যামাচরণ মুর্মুর সঙ্গে। তার দুটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। ২০০৯ সালে তার বড় ছেলে একটি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়, তখন তিনি খুব গভীরভাবে ভেঙে পড়েন। এরপর যখন আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে থাকে ২০১৩ সালে তার দ্বিতীয় ছেলেরও মৃত্যু হয় । এরপর আবার ২০১৪ সালে তার স্বামী মারা যায়। নিজের দুই ছেলে এবং স্বামীকে হারিয়ে নিজে অনেক ভেঙ্গে পড়েন তা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সামলে জীবনে এগিয়ে গেছেন। তার একটি মাত্র মেয়ের নাম ইতিশ্রী মুর্মু । দ্রৌপদী মুর্মু নিজের ও স্বামীর সব সম্পত্তি দান করেন আশ্রমে। খাওয়ার জন্য প্রতিবেলায় দুইটি রুটি জোগাড় করতে যে অর্থ প্রয়োজন তা রেখে আয়ের অতিরিক্ত সব অর্থই দিয়ে দেন আশ্রমে নয়তো মানবসেবায়। দ্রৌপদীর একমাত্র মেয়ে ব্যাংকে চাকরি করেন। আর জীবিত একমাত্র ভাই তাঁর শহরের বাড়ি দেখাশোনা করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর এই বাড়িও যাবে আশ্রমের মালিকানায়। অর্থাৎ নিজের বলতে কিছুই রাখেন নি তিনি সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন মানবসেবায়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি বরাবরই চমক দেয়। ২০১৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিহার রাজ্যের গভর্নর ও দলিত সম্প্রদায়ের রামনাথ কোবিন্দকে মনোনয়ন দেয় বিজেপি। আর এবার দিলেন দ্রৌপদী মুর্মুকে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও এখনো ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে ধর্ম-বর্ণের উপরে যোগ্যতার মূল্যায়ন বেশি হয়। এটা আপনি স্বীকার করেন বা না-ই করেন। আর সেকারণেই আমরা দেখি সমাজের সব থেকে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সন্তান রামনাথ কোবিন্দ, দ্রৌপদী মুর্মুরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে বসতে পারেন, এটিই ভারতের শক্তির উৎস, বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অখন্ড অবস্থায় টিকে থাকার মূলমন্ত্র। 


লেখক-হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat