×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-২৫
  • ৫২৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানি সংকটে হু হু করে বাড়ছে তেল-গ্যাসের দাম, যার প্রভাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ঘরবাড়ি ও শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহে খরচ বেড়েছে অনেক যা মূল্যস্ফিতির চাপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে গোটা বিশ্বে জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে যার আঁচ পড়ছে সবদেশেই। ইতোমধ্যে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে দেখা দিয়েছে গণবিক্ষোভ। ইউরোপ আমেরিকার দেশসমূহও জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, নিচ্ছে নানামুখী পদক্ষেপ। বাংলাদেশও এর বাইরে না, জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সারাদেশে এলাকা ভিত্তিক লোডশেডিং করা বা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জ্বালানি সাশ্রয়ে লক্ষ্যে বাংলাদেশের সরকার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। অবস্থা যখন বেগতিক, জ্বালানি সংকটে যখন টালমাটাল অবস্থা তখন আবারো বিপদে বন্ধুর ন্যায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত। সংকট নিরসনে ভারত থেকে আনা হয়েছে ২৫ লাখ লিটার জ্বালানি তেলচলমান জ্বালানি সংকট নিরসনে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অকটেন পেট্রোলসহ বিভিন্ন জ্বালানি পণ্যের কাঁচামাল ন্যাপথা আমদানি করা হয়েছে১৯শ মেট্রিক টন ন্যাপথা রূপান্তর করে ২৫ লাখ লিটার জ্বালানি তেল উৎপন্ন করা হবে। এ ন্যাপথা পরিশোধিত হওয়ার পর ৮০ শতাংশ অকটেন, ৫ শতাংশ পেট্রোল ও ৭ শতাংশ কোরোসিন উৎপাদিত হবে। যা দেশের চলমান জ্বালানি সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পর থেকেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে জ্বালানি তেল সঙ্কট। সঙ্কটের কারণে অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ইতোমধ্যেই তেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।  প্রতিবন্ধকতা শুরু হয়েছে জ্বালানি তেল আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রেও। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সকল সঙ্কট উপেক্ষা করে তেল আমদানির এই পুরো প্রক্রিয়াটি নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় সম্পন্ন করেউল্লেখ্য, গত ২৩ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকাবাহী জাহাজটি দুদেশের মধ্যে নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় আসা প্রথম তেলবাহি জাহাজ। যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর থেকে এ মাসের ৯ তারিখ ছেড়ে আসে। এই চুক্তির আওতায় এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে ইতোমধ্যেই ১৬ হাজার মেট্রিক টন তেল আনার অনুমতি দিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। যা পর্যায়ক্রমে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ভারত নিজেও জ্বালানি সংকটে ভুগছে কিন্তু প্রতিবেশিকে ভুলে যায়নি। আর তাইতো বৈশ্বিক এই সংকটে তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমাদেরকে সহায়তা করছে। কিন্তু এই ভালো কাজের মাঝেও একদল সমালোচনায়রত, তাদের গাত্রদাহ যেনো থামছেই না! তারা নতুন প্রোপাগান্ডা নিয়ে এবার মাঠে এসেছে আর তা হলো, ভারত সরকার নাকি কম দামে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনে তা বেশি দামে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করছে। অথচ বাংলাদেশ যদি অপরিশোধিত তেল ন্যাপথা রাশিয়া বা ভিন্ন কোন জায়গা থেকে আনতো তবে সেখানে আমদানি ব্যয় আরো বেশি পড়তো। আরেকটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতো সময়, ভারতের হলদিয়া থেকে দূরত্ব কম হওয়ায় ন্যাপথা খুব দ্রুত ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছেএটির প্রক্রিয়াকরণ করতেও সময় কম লাগে। আগে এটা প্রথমে চট্টগ্রামে আসতো, পরে তা অ্যাকোয়া রিফাইনিংয়ে আসতো। যার ফলে ভাড়া বেশি পড়তো। এখন সময় কম লাগার কারণে দ্রুত ন্যাপথা থেকে ফুয়েল উৎপাদন করে জ্বালানি সংকট দূর করা যাবে।

তাছাড়া ভিন্ন দেশ থেকে আনতে গেলে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে যে সংকট পোহাতে হতো সেটা জ্বালানি সমস্যাকে আরো বেশি জটিল করে তুলতো। কারণ বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা তা সকলের জানা।

তার মানে সমালোচকরা যা বলছেন তার বিপরীত মেরুতে হলো বাস্তবতা। এখানে হিসেব করে দেখা যাচ্ছে ভারতের এই ন্যাপথা আমদানিতে সময় ও আর্থিক দুই দিক থেকেই লাভবান হচ্ছে বাংলাদেশ। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, তবে সমালোচনাকারীরা মূলত কিসের ভিত্তিতে কথা বলছেন? তারা কি চাইছেন, ভারত থেকে এই ন্যাপথা না এনে ভিন্ন কোন দেশে থেকে সরকার আনুক যেনো অপরিশোধিত তেল আনতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং জ্বালানি সংকট আরো তীব্র হয়! নাহলে কোন যুক্তিতে তারা এর বিরোধীতা করছেন?

আবার আজকে যারা এই তেল আমদানির বিরোধীতা করছেন তারাই কিন্তু কিছুদিন আগে বাংলাদেশ যখন কম দামে এলপিজি গ্যাস বিদেশ থেকে এনে ভারতের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে বেশি দামে রফতানি করছিলো তখন এর সমালোচনা করেছিলো। তখন তথাকথিত জাতীয়তাবাদীরা বলেছিলো, বিদ্যুৎ সমস্যার মাঝে দেশ আরো বেশি সমস্যায় পরলেও ভারতকে খুশি করতে নাকি বাংলাদেশ সরকার এই গ্যাস রফতানি করছে! তারা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছিলেন যে, আমাদের দেশেই গ্যাসের অভাবে বিদ্যুতের সমস্যা হচ্ছে অথচ আমরা ভারতকে গ্যাস দিয়ে দিচ্ছি সব! অথচ এটা ছিলো ডাহা মিথ্যা কথা! কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করা হয় নালিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এল পি জি অথবা এল পি গ্যাস) চাপে তরলীকৃত জ্বালানি গ্যাস এটি মূলত দাহ্য হাইড্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ এবং জ্বালানি হিসেবে রন্ধন কার্যে, গাড়িতে ও ভবনের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে (HVAC) ব্যবহৃত হয়। নূন্যত্বম পড়াশুনা করলেও এটা জানার কথা যে, এলপিজি গ্যাস কখনোই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়না। অথচ এরপরেও আমরা দেখেছে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা এলপিজি গ্যাস ভারতে রফাতানির সমালোচনা করে তখন বক্তব্য দিয়েছিলেন।  

ভারত-বাংলাদেশ এর যেকোন চুক্তি বা সম্পর্ক নিয়ে একটি চক্র সর্বদা জনগণের কাছে ভুল বার্তা দেয়। দেশ বিক্রির ধোঁয়া তোলা তো সেই পুরাতন অভ্যাস যা এখনো বিএনপি করেই যাচ্ছে। কিন্তু এতোকিছুর পরেও বাংলাদেশ-ভারত একে অপরের পাশে সর্বদা বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার যখন আবারো জ্বালানি সংকটে পড়লো গোটা বিশ্ব তখন সেই ভারতই এসে সহায়তার হাত বাড়ালো। বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের যে ঘাটতি, তার প্রধান কারণ হলো জ্বালানি তেলের অপ্রতুলতা। দেশে ন্যাপথা অয়েল আমদানির ফলে ফুয়েলের যে ঘাটতি, তা কিছুটা পূরণ হবে। আর সরকার বছরে এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন ন্যাপথা নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে। আগামীতে আরও ন্যাপথা দেশে আসবে। আশা করা হচ্ছে ন্যাপথা বাংলাদেশের ১০ শতাংশ অকটেনের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে টালমাটাল বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা। ওই সময় বিশ্বের বৃহত্তম তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক ও নিত্যপণ্যের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী ছিল রাশিয়া। এমন পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় বৈশ্বিক জ্বালানি খাতের বিশৃঙ্খলায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর কথা সবাই বলছেন। বিশ্বব্যাপী পরিশুদ্ধ জ্বালানির জন্য পদক্ষেপ নেয়ার দিকে জোর দিচ্ছেন। গত সপ্তাহে সিডনিতে এক বৈশ্বিক জ্বালানি সম্মেলনে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) প্রধান ফাতিহ বিরল বলেন, গভীরতা ও জটিলতার দিক থেকে এত বড় জ্বালানি সংকট এর আগে দেখেনি বিশ্ব। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়তো এখনো আসেনি। এটি সারা বিশ্বকেই ভোগাচ্ছে। ইতোমধ্যে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপে এবারের শীতকাল হবে কঠিন, খুব কঠিন। স্মরণকালে ইউরোপ এমন সময় পাড় করেনি বলে মতামত দিচ্ছেন তারা। বাস্তবতা যখন এমন তখন আমাদের কাঁধে হাত রেখে ভারত আবার জানান দিলো নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসিতে তারা কতোটা এগিয়ে নিঃসন্দেহে জ্বালানি সংকটের এমন মুহুর্তে ভারতের এই সহায়তা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরো মজবুত করবে, নিয়ে যাবে ভিন্ন এক উচ্চতায়।

লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat