×
  • প্রকাশিত : ২০২২-১১-১৭
  • ৮৩১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চারদিনের সফরে ভারত যান গত সেপ্টেম্বরে।  এ সফর থেকে কী পাওয়া গেল, কার লাভ আর ক্ষতি তা নিয়ে চলেছে নানামুখী আলোচনা। বহুল প্রত্যাশিত তিস্তাচুক্তি এ সফরে সম্পাদিত হবে না-এমনটা আগেই জানা ছিলো। এবারের সফরে দুই দেশ সাতটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। তবে এই সফরে দুই দেশের আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সফরের পর পরেই আমরা সবাই সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি কি হয়েছে তা নিয়ে আলোচনাতে মেতে উঠেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সফরে দৃশ্যমান সমঝোতা স্মারকের বাইরেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দুই দেশ একমত হয়েছে। সমঝোতা স্মারকের বাইরে এবার যে সিদ্ধান্ত এসেছে  তা দুই দেশের চলমান বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

ভারতের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেফা চুক্তি নিয়ে অনেক আগে থেকেই ভাবা হচ্ছিলো। এবার সেই কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টের (সেপা) বিষয়ে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করার জন্য সম্মত হয়েছেন। সেপা মূলত একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। এটি এমন এক চুক্তি, যার লক্ষ্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রস্তাবিত কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট বা সেপা নামে একটি নতুন চুক্তির কথা ভাবা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই, ২০১৮ সাল থেকেই ভারত এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। এই চুক্তি স্বাক্ষর হলে দুই দেশের বাণিজ্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। চুক্তির প্রথম বছরেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়বে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে একটি উইন-উইন সিচুয়েশন  তৈরি করতে সক্ষম হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই) এক সমীক্ষা পরিচালনা করে এমন তথ্য উপস্থাপন করেছে। যদিও সেপা চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগে এর কোন তথ্য উপাত্ত বা সমীক্ষা ফল তারা উন্মুক্ত করেনি। আবার ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও অনুরূপ সমীক্ষা পরিচালনা করছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফরেন ট্রেড (আইআইএফটি)। তারা জানাচ্ছে , শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করতে এই চুক্তি যেমন কাজে দেবে তেমনি কেউ চাইলেই চুক্তির তালিকায় থাকা পণ্যে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসিয়ে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে সেপা চুক্তি হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত বাধাগুলো দূর হবে। তখন যৌথ টেস্টিং সার্ভিস, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হবে। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বর্তমান রপ্তানি আয়ের বাইরে আরও ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।

দ্বিপক্ষীয় এমন বাণিজ্যিক চুক্তি নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এই ধরণের চুক্তি উভয় দেশকে লাভবান করে। তবে কার্যকর কোন চুক্তি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খুব একটা পরিলক্ষিত হয়না। সার্কের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার প্লাটফর্ম এ অঞ্চলের শতকোটি মানুষের মাঝে অনেক আশা-ভরসা সৃষ্টি করলেও একসময় আঞ্চলিক বা বহুপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নানা জটিলতার কারণে খুব একটা এগোতে পারেনি। সার্ককে কখনো অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যক সহযোগিতার চুক্তি হিসাবে মনে করা যায়নি। আবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ১৯৯৩ সালে সম্পাদিত সাফটা চুক্তি প্রকৃত অর্থে ২০০৬ সালে কার্যকর হলেও কোনো সুফল বয়ে আনেনি। এর কারণ হিসাবে যেসব বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা যায় তা হলো, সার্কের দুই সদস্য দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে বৈরিতা, ভারতের প্রতি ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর সন্দেহ ও অবিশ্বাস, বেশিরভাগ সদস্যগুলোর মাঝে সাফটার কার্যকারিতার বিষয়ে আন্তরিকতাসহ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। কিন্তু বিশদ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব, বিনিয়োগ, কানেক্টিভিটি এবং সেবাভিত্তিক পণ্য বাণিজ্যের বিষয়গুলো সাফটায় অনুপস্থিত ছিল। ইতোমধ্যে ভুটানের সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তি সম্পাদন করেছে ভারত। সার্কের সদস্য দেশ ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ডসহ সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। শ্রীলংকা ২০০৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেছে। ভারত ও চীনসহ অনেক দেশ থেকেই মুক্তবাণিজ্য চুক্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব এলেও বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ার কারণে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে অবস্থান করছিল। এবার ভারত সফর শেষে ভারতের সঙ্গে সেপা চুক্তি করার জন্য আলোচনা শুরুর জন্য দুপক্ষই একমত হয়েছে। ধারণা করা যায়, অতি দ্রুত এ চুক্তি সম্পাদিত হবে।

ভারত-বাংলাদেশ দু দেশের জন্যই সেপা চুক্তি দরকার। বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আকর্ষণীয় মাথাপিছু আয় তথা ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় বৃহৎ একটি ভোক্তা বাজারের উদ্ভব, রপ্তানি বৃদ্ধিজনিত কারণে বিশাল আকারের সাপ্লাই চেইনের চাহিদা, প্রায় বিচ্ছিন্ন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি বিশদ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারত্বের প্রয়োজনীয়তা ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে সেপা চুক্তি করার বিষয়ে আগ্রহী করতে অন্যতম উপাদান হিসাবে কাজ করছে বলে বিবেচনা করা যায়। আবার ভূরাজনীতি ফ্যাক্টর বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ভারতের সহায়তা অপরিহার্য। তাই দুই দেশের জন্যই এমন একটু চুক্তি দরকার।

প্রস্তাবিত এ সেপা চুক্তির তিনটি মাত্রা রয়েছে। পণ্য বাণিজ্য, সেবা বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ। এর মূল লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা, দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটিসহ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অন্যান্য সুযোগ কাজে লাগানো। এ ছাড়া এ চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যেসব বিষয় রয়েছে তা হলো-সাপ্লাই চেইনের অবাধ প্রাপ্তি নিশ্চিত, প্রতিরক্ষা সামগ্রীর যৌথ উৎপাদন এবং যৌথ উদ্যোগে ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য ওষুধ সামগ্রী উৎপাদন।

সেপা চুক্তি সম্পাদিত হলে কয়েক বছরের মধ্যে উভয় দেশের বাণিজ্য প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বড় ধরনের একটি বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এ চুক্তি বাণিজ্য ঘাটতি বেশ কমিয়ে আনবে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে বিবিআইএন এবং বিমসটেক পূর্ণমাত্রায় কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। এ চুক্তির ফলে যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন নতুন উৎপাদনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে উভয় দেশের সাপ্লাই চেইনের বিরাজমান বাধা দূরীভূত হবে।

সেপা চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাণিজ্য বাধাগুলো দূর হয়ে গেলে পাল্টে যাবে বাংলাদেশের আমদানি চিত্রও। ভারতের বেশিরভাগ পণ্য ও সেবা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে সহনীয় বলে এবং পরিবহণ খরচ কম ও সময় সাশ্রয়ের কারণে বাংলাদেশি আমদানিকারকরা একই পণ্যের জন্য দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর বদলে ভারতমুখী হবে। তখন ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়বে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান ৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি আরও ৪ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়ে যাবে। তাই দুই দেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে এই চুক্তি খুব বেশি প্রয়োজন। তাছাড়া স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিবেশী ভারতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে দেশটির বাজারে আরও বেশি বাণিজ্যসুবিধা সৃষ্টির জন্য সেপা চুক্তি স্বাক্ষরে কাজ করা হচ্ছে। সেপা চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কের নতুন দ্বার খুলে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

লেখক- হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat