১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের
ওপর পশ্চিমাংশের কর্তৃত্বের ইতিহাস সবার জানা। দেশভাগ এবং তৎপরবর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্র
গঠনের মধ্যে যে স্বাভাবিক বৈপরীত্য রয়ে গিয়েছিল, তা ক্রমে বাড়তে থাকার ফলে বাংলাদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। বাঙালিদের প্রত্যক্ষ জাতিগত নিপীড়নের চূড়ান্ত
রূপটি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে একাত্তরের গণহত্যার
মধ্য দিয়ে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালিদের সংগ্রাম, বিশেষত ১৯৬৬ সালের পর শেখ মুজিবুর
রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে
যাওয়া ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার। এদিকে একাত্তরের ঘটনাবলি ভারতের সামনেও আঞ্চলিক আধিপত্য
সংহত করার বিরাট সুযোগ এনে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতের ভূমিকা নির্ধারক
হয়ে দেখা যায়। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি
বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল
সংখ্যক ভোট পেয়ে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ৷ শপথ
গ্রহণের আগেই এই উপমহাদেশের ভয়াবহ গণহত্যা প্রত্যক্ষ করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীকে। রক্তের
হোলিখেলার মাঝে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হয়নি কোন পক্ষে যাবেন তিনি। একটি উদার
ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেন
এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধকে
সমর্থন করে গোটা বিশ্বে আমাদের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা
জানা অজানা ইতিহাস রয়েছে। অনেক ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ আকারে আছে যা আমরা জানি আবার
অনেক ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকলেও দলিল আকারে তা অবমুক্ত করা হয়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ
ঐতিহাসিক দলিল ভারতের হেফাজতে রয়েছে যা আজ নাগাদ প্রকাশ করেনি ভারত সরকার। তবে
সম্প্রতি ভারত সরকার পঞ্চাশ বছর আগে যে ঐতিহাসিক
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম এবং যে যুদ্ধের সামরিক অঙ্গনে ভারতেরও গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা ছিল–ভারতের হেফাজতে থাকা সেই সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল দস্তাবেজ
ও নথিপত্র অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সব দলিল অবমুক্ত হলে নতুন
কী তথ্য জানা যেতে পারে? এই প্রশ্ন এখন সবার মনে।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা
হয়। এই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একার গর্বের বিষয় না বরং
সেটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্যও গর্বের মুহূর্ত। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের প্রথম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় ২৬ মার্চ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ
সিং তাঁর সরকারের উদ্বেগের কথা জানান। পরদিন ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বাংলাদেশের
পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক হয়। রাজ্যসভায় এক বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি
মোকাবিলার কথা বলেন। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের
স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন দেন। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত খুলে
দেওয়া হয়। পশ্চিমবাংলা, বিহার, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সীমান্তে শরণার্থী শিবির খোলা
হয়। ভারত সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের শুধু আশ্রয় ও লালন পালনের দায়িত্ব পালন করেই
যে চুপ ছিল তা কিন্তু নয়। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার সরকারদের
স্ব স্ব স্থানে রিফিউজি ক্যাম্প এবং গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয়
নির্দেশ দেয়। নির্বাসিত বাংলাদেশি সেনা অফিসার ও স্বেচ্ছাসেবীরা ওইসব ক্যাম্প থেকে
মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত হয়। রিফিউজির পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী
গেরিলাদের রিক্রুট করে নিয়ে এসে ট্রেনিং দেওয়া হয় । সবাই পায় গেরিলা প্রশিক্ষণ, ঘুরে
দাঁড়ায় বাঙ্গালি, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ পেয়ে তারা সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে
প্রবেশ করতো এবং একের পর এক অপারেশন চালাতো। আমরা সরলভাবে এই ইতিহাস জানলেও জানিনা
মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অস্ত্র সাহায্যের পেছনে কী ধরনের পরিকল্পনা ছিল?
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ যুদ্ধের জন্য কী ধরনের কৌশল ঠিক করেছিলেন
বা অধস্তন কর্মকর্তাদের কী ধরনের নির্দেশ পাঠাচ্ছিলেন? এই স্পর্শকাতর তথ্যগুলো কিন্তু
আজ পর্যন্তই সকলের কাছে অজানা। পাঠক ও ইতিহাসবিদদের জন্য নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ
দলিল হতে যাচ্ছে ভারতের হেফাজতে থাকা এই অপ্রকাশিত নথিপত্র।
যেকোন যুদ্ধে জয়ের জন্য পরিকল্পনা একটা মুখ্য বিষয়। শক্তি সামর্থ্যে আপনি কতোটুকু
এগিয়ে তার চাইতে বড় বিষয় আপনার পরিকল্পনা কী! পরিকল্পনা কতোটুকু বাস্তবায়ন ফিল্ড লেভেলে
করতে পারছেন এবং যুদ্ধের পরিকল্পনাকে আপনি কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তার উপর যুদ্ধ জয়
নির্ভর করে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে
পাকিস্তানের চাইতেও অপেক্ষাকৃত কম সমরাস্ত্র নিয়ে জয়ের পেছনে রয়েছে আমাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার পর আমাদের যুদ্ধ শুরু হলেও ২১ নভেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী আক্রমণ করে
পাকিস্তান বাহিনীর উপর। অনেকের প্রশ্ন কেন এত দেরিতে ভারতীয় বাহিনী আসল, আরো আগে কেন
আসেনি! এর পেছনেও রয়েছে এক যুদ্ধ কৌশল। প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের স্বীকৃতি
ব্যতীত ভারত এই যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনা তাই আগে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছে এপ্রিলে।
তাহলে মে বা জুন জুলাইয়ে কেন ভারতীয় বাহিনী আসেনি ? এই প্রশ্ন কিন্তু আসতে পারে। সেখানেও
রয়েছে এক ভিন্ন পরিকল্পনা। যেহেতু চীনকে মাথায় রেখেই ভারতীয় সেনাবাহিনী মাউন্টেন ওয়ারফেয়ার, হাই অল্টিচিউড লড়াইয়েরই
প্রশিক্ষণ নিতেন, অস্ত্রশস্ত্র বা স্ট্র্যাটেজিও সেভাবেই জোগানো হত। সেখানে বাংলাদেশে
নদীনালায় ভরা একটা সমতলভূমি, সেই জলময় পরিবেশে যুদ্ধের জন্যও ভারতীয় সেনাবাহিনির
আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। আবার বাংলাদেশে জুন থেকে অক্টোবর হলো বর্ষাকাল। তখন
গোটা বাংলাদেশ এক প্রকাণ্ড জলাভূমির চেহারা নেয়। আর তাই ভারত চেয়েছে মুক্তিবাহিনী
দিয়েই পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণভাবে সেই সময়টা বিপর্যস্ত করে বর্ষার পর যৌথ আক্রমণ চালাতে।
কেননা বর্ষার মাঝে যুদ্ধ করে টিকে থাকাটা ভারতের সেনাবাহিনীর জন্যও একদম অচেনা একটা
পথ ছিলো। অপরদিকে মুক্তিবাহিনী নিজের পরিবেশ বা স্থান সম্পর্কে ভালো জানা থাকায় বর্ষায়
তারা একের পর এক আক্রমণে পাকিস্তানকে পর্যদুস্ত করেছে, পুরো বর্ষা পাকিস্তান সেনাদের
ঘিরে রাখতে পেরেছে। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্যও এই বর্ষা মৌসুমে যুদ্ধ একদম নতুন
অভিজ্ঞতা ছিলো।বর্ষা থামতেই চারদিক থেকে পাকিস্তান সেনাদের আক্রমণ করা হল, পাকিস্তান
তেমন প্রতিরোধ গড়তেই পারল না - খুব দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।
এদিকে পাকিস্তান তার শেষ অস্ত্র হিসেবে ৩ ডিসেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করে। উদ্দেশ্য, এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে গিয়ে ভারতকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য
করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মতামত গঠনে ভারত সফল হওয়ায়, বিশেষত জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের
সমর্থন থাকায়, ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় অত্যন্ত দ্রুত বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে।
পাকিস্তানের যুদ্ধের পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে যায়। এককভাবে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি
বাহিনীকে হারানো পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে ভারতীয় বাহিনী দ্রুতবেগে ঢাকার দিকে যাত্রা
করে। পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা অবশ্য তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ তৈরি করে দেয়।
এই ইতিহাসগুলো আমরা জানলেও জানিনা যুদ্ধের পরিকল্পনায় কলকাতায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ারের
প্রধান জগজিৎ সিং অরোরার অবদান কী ছিল? উনি ঠিক কিভাবে তার যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন।
এই অজানা দলিল অবমুক্ত হলে এক নতুন ইতিহাস জানতে পারবে এই অঞ্চলের মানুষ।
এছাড়াও আত্মসমর্পণে পাকিস্তানি সেনাকে বাধ্য করার ক্ষেত্রে ভারতের আর একজন জেনারেল
জে এফ আর জেকবের ভূমিকা নিয়েও নানা রকম তর্কবিতর্ক আছে– কিন্তু আসল সত্যিটা
কী? বা বঙ্গোপসাগরে পাকিস্তানি ডুবোজাহাজ পিএনএস গাজীর ধ্বংস হওয়ার পেছনে আসল রহস্যটা
কী? তাছাড়া যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে
সেনাবাহিনী কী ভেবেছিল? পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেই বা তাদের
কী মত ছিল? এরকম আরও বহু বিষয়, আরও অজানা ইতিহাস এবং নানা জিজ্ঞাসার সুস্পষ্ট উত্তর
জানতে পারবে সবাই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অনন্য
ভূমিকার ইতিহাসকে খাটো করে দেখার অপপ্রয়াস অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ সমগ্র ভারতবাসী, ইন্দিরা গান্ধী তথা ভারত সরকার এবং বিএসএফ
ও ভারতীয় সৈন্যদের কিংবদন্তি সাহায্য-সহযোগিতা ও আত্মত্যাগের সফল পরিণতি বাংলাদেশ।
এই কথাটা আমরা অনেকেই স্বীকার করতে চাইনা। আমরা অনেকেই ভারতের সামরিক কৌশলগত স্বার্থকে
সামনে আনি, কিন্তু একবারো ভাবিনা বাংলাদেশের জন্য ভারতবাসীর এতটা ত্যাগ ও ভালোবাসা
এতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনাকে অপমান করা হয়। ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে অজানা দলিল
দস্তাবেজ অবমুক্তকরণের উদ্যোগ নিয়েছে তাকে স্বাগতম জানাই। একাত্তরে ভারত-বাংলাদেশ
কিভাবে এক হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে একটি স্বাধীন মানচিত্র ছিনিয়ে এনেছে এর
বিস্তারিত ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এই দলিল
প্রকাশ করার মাধ্যমে সবার সামনে আসবে বলে
আমাদের বিশ্বাস।
লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।