×
  • প্রকাশিত : ২০২২-১২-২৮
  • ৪২৩ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

চলাচল শুরু করছে ঢাকা মেট্রোরেল। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম এক উচ্চতার প্রতীক এই মেট্রোরেল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারী শিল্প সক্ষমতার পরীক্ষায় পাশ করলো বাংলাদেশ। প্রথম আন্তর্জাতিক মানের এ অবকাঠামো তৈরির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল, বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক মানের  নির্মাণ সামগ্রী ও পরিষেবা উৎপাদন করতে পারে। তবে এই পুরো প্রকল্পে জাপানি প্রকৌশলীদের অবদান থাকলেও মূল কাজে মাথা খাটান এক ভারতীয়। এক ভারতীয়ই মূলত এই মেট্রোরেল প্রকল্পের গতিপথকে  পাল্টে দেন। বাঁচিয়ে দেন মেট্রোরেল প্রকল্পের অনেক বাড়তি খরচ। আমাদের অনেক খরচ বাঁচিয়ে দেয়া মানুষটি ভারতের মেট্রো ম্যান  খ্যাত ই শ্রীধরন। 

ঘটনার শুরু বহু আগে। ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে ২০০৫ সালে একটি ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লুইস বার্জার গ্রুপ ইনকরপোরেশন। এ পরিকল্পনায়ই প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ঢাকার জন্য তিনটি মেট্রো লাইনের একটি সম্ভাব্য রুটও চিহ্নিত করা হয় এসটিপিতে। এ রুটগুলোর একটি ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হতে যাওয়া (একাংশ) উত্তরা-মতিঝিল-কমলাপুর মেট্রো বা এমআরটি লাইন-৬। বর্তমানে পুরোটাই উড়ালপথে তৈরি মেট্রোর কাজ ঢাকায় দেখলেও প্রথমদিকে মেট্রোটির গতিপথ কিছুটা ভিন্ন ছিল। মেট্রোরেলের কাজে নিয়োজিত জাইকার প্রকৌশলীরা উত্তরা মতিঝিল মেট্রোর নকশা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেন।  জায়গার নকশা অনুযায়ী মেট্রোর অর্ধেক অংশ থাকবে মাটির উপরে আর অর্ধেক অংশ হবে মাটির নিচ দিয়ে। তবে নকশা চূড়ান্ত করার আগে আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা নেয়ার একটা বিষয় ছিল আর এজন্য ভারতের স্বনামধন্য মেট্রোরেল বিশেষজ্ঞ ই শ্রীধরনকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানায় জাইকা। উদ্দেশ্য ছিল ই শ্রীধরনের কাছ থেকে ভারতীয় মেট্রোর অভিজ্ঞতা নিয়ে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রো নকশা চূড়ান্ত করা। শ্রীধরন প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে একটা প্রেজেন্টেশন দিলেন। প্রেজেন্টেশনে শ্রীধরন বলেছিলেন, পাতাল মেট্রো নির্মাণ ও সেটি পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আমরা ৮৪-তে বানিয়ে (কলকাতা মেট্রো, ভারতের প্রথম মেট্রো) ভুল করেছি। পরবর্তী সময়ে এক্সটেনশন লাইনটাও আন্ডারগ্রাউন্ড করিনি। যত কিছু বানাচ্ছি, হিস্টোরিক্যাল যদি কোনো কনস্ট্রেইন্ট না থাকে, তাহলে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাই না। সেটা শ্বেতহস্তী হয়ে দাঁড়ায়। আন্ডারগ্রাউন্ড করতে গেলে তোমরা কখনো সেটা পপুলার করতে পারবা না।

অর্থাৎ ভারতের মেট্রো ম্যান নির্মাণ ও পরিচালন ব্যয় এর কথা চিন্তা করে পাতালপথে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে না বরং উড়ালপথে তথা ফ্লাইওভার নির্মাণের পরামর্শ দেন। এরপর দ্রুতই জাইকা ইউটার্ন নেয়। ইউটার্ন নিয়ে পুরোটাই এলিভেটেড করে ফেলে। ২০০৯-১০ ও ২০১১-১২ সালে দুই দফা তত্কালীন ডিটিসিবির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন। শ্রীধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এসটিপিতে তিনটি মেট্রোরেল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে জাইকার সমীক্ষায় নম্বর-৬-কে (উত্তরা-মতিঝিল) যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং মেট্রোটি সবার আগে নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হয়। তখন শ্রীধরন নামের এক ভদ্রলোককে জাইকা আমন্ত্রণ জানিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। রুটটি নির্মাণে শ্রীধরন গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন।

শ্রীধরনের পুরো নাম ইলাত্তুভালাপিল শ্রীধরন। জন্ম ১৯৩০ সালের ১২ জুন, ভারতের কেরালায়। পেশায় প্রকৌশলী শ্রীধরন ভারতের মেট্রো ম্যান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ১৯৮৪ সালে ভারতের প্রথম মেট্রোরেল তৈরি হয় কলকাতায়। মেট্রোটি নির্মাণে নেপথ্য ভূমিকা ছিল তার। তার হাত ধরেই দেশটির কোচি, লখনৌ ও জয়পুরে মেট্রো প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীধরনের সম্পৃক্ততা ছিল মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন রেলওয়ে প্রকল্পেও। রেলওয়ের বাইরে ভারতে প্রথম সমুদ্র সেতু তামিলনাড়ুর পাম্বান সেতু নির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন শ্রীধরন। ৯০ বছর বয়সী এ প্রকৌশলী পেশাগত জীবনে সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন দিল্লি মেট্রোর প্রধান হিসেবে।

ঢাকা মেট্রোরেল তৈরির আগে নকশা চূড়ান্ত হওয়া নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, একাধিকবার গতিপথ পরিবর্তন করা হয় এই মেট্রোর। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেট্রো প্রকল্পটির পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ বা ডিটিসিএ। এতে মেট্রোরেলের জন্য নির্ধারিত রুট হিসেবে উত্তরা থেকে ফার্মগেট-শাহবাগ হয়ে কাপ্তানবাজার-সায়েদাবাদ এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়। অবশ্য সে বছরই রুটটি কিছুটা পরিবর্তন করে শাহবাগ থেকে সায়েদাবাদের বদলে মতিঝিল-কমলাপুরের পথে নিয়ে যায় তত্কালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।

জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, উত্তরার তিন কিলোমিটারে মেট্রো তৈরি হওয়ার কথা ছিল মাটির সমান্তরালে। সেখান থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন পর্যন্ত উড়ালপথে। আর মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোটি পাতালপথ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। মাঝের অংশটি উড়ালপথে নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছিল। ২০০৫ সালের এসটিপিতে সুপারিশের পর মেট্রোরেলের পরিকল্পনা ও নির্মাণের সব পর্যায় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে সরাসরি অংশও নিয়েছেন তিনি। ড. সামছুল হক জানিয়েছেন, নকশা প্রণয়নের সময় জাইকার প্রকৌশলীরা উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মাটির সমান্তরালে নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পাতালপথে নির্মাণ করার কথা ছিল।

২০১২ সাল মুহুর্তেই সবকিছুকে পাল্টে দেয়। ভারতের মেট্রোম্যান এর এক প্রেজেন্টেশন আমাদের দেশের প্রকৌশলীরাও বিনাবাক্যে মেনে নেয়। আজকের দৃশ্যমান মেট্রোরেল আমাদেরকে হাজার কোটি টাকার লোকশান থেকে বাঁচিয়ে দেয়।

রাষ্ট্রচিন্তায় যদি থাকে দেশ ও মানুষের কল্যাণ, তার প্রতিফলন দেখা যায় সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায়। এসব নীতি-পরিকল্পনার আলোকেই গৃহীত উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনের মূলে রয়েছে মানুষ। অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ। তাই তাঁর উন্নয়ন কার্যক্রমগুলোর দিকে আলোকপাত করলে দেখা যাবে, এ পর্যন্ত মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে যত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, তার সবই দেশ ও মানুষের উন্নয়ন ঘিরে। আর একারণেই দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এই সরকার সবেচেয়ে এগিয়ে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে যতো সরকার এসেছে সবাইকে পেছনে ফেলে একের পর এক মেগা প্রজেক্ট সফলতার সাথে করে যাচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। মেট্রোরেল সেই ধারাবাহিক উন্নয়নের এক ফসল। তাই মেট্রোরেলের ইতিহাসের সাথে যেমন জাপানের নাম থাকবে তেমনি থাকবে এক ভারতীয়র নাম, যিনি এক সিদ্ধান্তে পাল্টে দিয়েছিলেন মেট্রোরেলের গতিপথ, বাংলাদেশকে হাজার কোটি টাকা লোকশান থেকে করেছিলেন রক্ষা।

লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ,

রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat