×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৪-২৩
  • ২৮১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

এক দুপুরে আমাদের মাঠে বসিয়ে কলাপাতায় গরম ভাত পরিবেশন করা হয়। সঙ্গে এক টুকরা করে খাসির মাংস। কেন এ বিশেষ খাবার, সে প্রশ্ন করায় উত্তর আসে- আজ ঈদ। ইংরেজি তারিখ ধরলে যত দূর মনে পড়ে ২০ নভেম্বর।

মুক্তিযোদ্ধা গবেষক অজয় দাশগুপ্তর স্মৃতি কথায় এভাবেই ১৯৭১ সালের রমজানের ঈদটি আমাদের সামনে ধরা দেয়, মুসলিম উম্মাহর আনন্দের এই দিনটিই কিনা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাদের কাছে ছিলো অজানা! অবশ্য অজানা থাকারই কথা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঈদ যে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিলো রক্তাক্ত, মলিন। আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে বিবর্ণ ছিল ঈদের সময়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের কীসের ঈদ! আগের বছর ১৯৭০ সালেও প্রলয়ঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়ে নিষ্প্রাণ হয় হাজারো মানুষ। হারিয়ে গিয়েছিল বাঙালির ঈদ। মানুষের দীর্ঘ অনাহার, হাহাকারে খেয়ে না খেয়ে থাকা লাখো উদ্বাস্তুর কাছে রমজান ছিল অজানা অধ্যায়। জানে না কেউ কীভাবে হবে উদ্ধার! এমনি এক সময় নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ ঈদ আসে বাঙালির জীবনে। যে ঈদ ছিলো বিষাদময়, যে ঈদের সময়টিতে বাংলাদেশের মানুষের চোখে মুখে ছিলো স্বাধীনতার দৃপ্ত অঙ্গিকার। আজ সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা যদি পঞ্চাশ বছর আগের ঈদের সময়টিতে ফিরে তাকাই তবে বিপন্ন, বিপর্যস্ত, গণহত্যার শিকার এক বাংলাদেশের ছবিই আমাদের সামনে ভেসে উঠে

একাত্তরে কেমন ছিল আমাদের ঈদ? কোটি শরণার্থী যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো সেখানে কী আদৌ ঈদ আনন্দ বলতে কিছু ছিলো! ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে আমরা যা পাই তাতে মোটেও শরণার্থী শিবিরের ঈদ আনন্দের সাথে উদযাপনের কোন চিত্র আমাদের সামনে ধরা দেয় না বরং নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে, নিজের পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ উদযাপন করতে এক অব্যক্ত স্পৃহা লক্ষ্য করা যায় শরণার্থী শিবিরে থাকা মানুষের মাঝে। কেননা উদ্বাস্তু জীবনে শরণার্থীদের ঈদ ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। যদিও অনেক শরাণার্থী শিবিরে ঈদের জামাত হয়েছিল। শরণার্থী হিসেবে যারা পরিবার নিয়ে ভারতে ছিলেন তাদের কাছে দিনটি যে কত বিষাদের ছিল- তার উত্তাপটা অনুভব করা যায় কলকাতায় একাত্তরের ঈদের দিনের সকালে শহিদ জায়া বেগম মুশতারি শফির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে প্রতিবেশীদের কথোপকথনে। বেগম মুশতারি শফি লিখেন-

আমার বাচ্চারা মুখ মলিন করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এমন ঈদ তো ওদের জীবনে কখনো আসেনি! আমার পাশের ঘরের খ্রিস্টান ছেলে-মেয়ে জ্যাফরী, ননাট, ললী এলো। ওদের বললো, তোমরা আজ নতুন কাপড় পরোনি? তোমরা ঈদ করবে না? ওদের প্রশ্ন শুনে আমার বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠলো, কি উত্তর দেবে আমার বাচ্চারা? আমি কান পেতে রইলাম। শুনলাম আমার বড় ছেলে এরাদ বলছে, না ললী, আমরা ঈদ করবো না।ওরা প্রশ্ন করছে, কেন? এরাদ বলছে, আমার কাকু বলেছে, দেশে যখন যুদ্ধ চলে, তখন কোন ঈদ করতে হয় না। এখন আমাদের সাথে আব্বু নেই, মামা নেই, ওদেরকে মিলিটারিরা নিয়ে গেছে। আমরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানি আর্মিকে হারিয়ে দেব, আর আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, আমরা দেশে ফিরে আব্বুকে পাবো, মামাকে পাবো তখন ঈদ করবো। ওর কথা শুনে কান্না সংবরণ করতে পারলাম না। আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম। হে খোদা তুমি আমার বাচ্চাদের ইচ্ছে পূর্ণ করে দাও। তুমি তো অলৌকিক কত কিছু দেখালে, আরেকটু দেখাও, সত্যিই যেন ওদের আমরা ফিরে পাই।

ঈদের দিন দিবাগত রাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ গোপনে কুষ্টিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আবেগঘন সাক্ষাতের পর রাতেই ফিরে আসেন কলকাতায় তাঁর কার্যালয়ে। আসার সময় তাঁর গাড়ি কলকাতার শরণার্থী শিবিরের পাশ দিয়েই এসেছিল। নিরাপত্তার কারণে তিনি সেখানে নামেননি। তবে তাঁর সঙ্গে থাকা নজরুল ইসলামের (মুক্তিবাহিনির সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা) স্মৃতিকথায় ঈদের রাতে সেখানকার শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতি উঠে এসেছে। তিনি লিখেন-

আমাদেরকে নিয়ে গাড়ির বহর পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের শেষ রাতের স্তব্দতা বিদীর্ণ করে কলকাতার অভিমুখে ছুটে চলল। সীমান্ত এলাকা ছেড়ে বেশ কিছু দূর অগ্রসর হলে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির। গাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসা ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার মিস্টার বোস প্রধানমন্ত্রীকে দেখালেন রাস্তার অদূরের কয়েকটি শরাণার্থী শিবির। শেষ রাতে আবছা আঁধারের আবরণে ঢাকা শরণার্থী শিবিরে লোকজনের কোলাহল, শিশুদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, সেখানে ঈদ আসেনি। তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের হায়েনা বাহিনি এদেরকে নিজ মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে পবিত্র ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপনের ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এটাই নাকি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ইসলাম রক্ষার জেহাদ?

... অদূরে কিসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। এ অসতর্ক মুহূর্তে অজ্ঞাতসারেই প্রশ্ন করে বসলাম, এটা কিসের আওয়াজ? আমার গাড়ির চলন্ত স্টিয়ারিংয়ের উপর হাত রেখে বসা ভারতীয় সামরিক ড্রাইভার বললেন, এটা ডিউবয়েল চাপার আওয়াজ। শরণার্থী শিবিরের লোকজন পানির কল চেপে পানি উঠাচ্ছে। রাতে ঘুম এদের চোখ থেকে পালিয়ে গেছে। ক্ষুধার অনলে জ্বলন্ত চোখে ঘুম আসবে কি করে?

ভারতে অবস্থানরত মুজিবনগর সরকারের ঈদ উদযাপন কেমন ছিলো! এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই খুব কম জানি। রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের একাত্তরের রণাঙ্গন: অকথিত কিছু কথা গ্রন্থে মুজিবনগর সরকারের ঈদ উদযাপনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সে গ্রন্থে রয়েছে- মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তরের ছোট মাঠে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে ঈদুল-ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে মুজিবনগরে খুব ঘটা করে ঈদুল-ফিতর উদযাপনের ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে মুসলিম দেশগুলোর কাছে ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানিদের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্যে। ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা। মুসলিম দেশগুলোর বিভ্রান্তি ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সৃষ্ট ভুল ধারণা মোচন করে তাদেরকে জানিয়ে দেয় যে বাংলাদেশের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, কোনো মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে বিধর্মীদের যুদ্ধ নয়। এটা স্বাধীনতাকামী একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই। ধর্মের দুশমন, মানবতার দুশমন এই ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধেই মুক্তিযুদ্ধ। এটাকেই প্রকৃত অর্থে সত্যিকারের জেহাদ বলা যেতে পারে। এজন্যে আগে থেকেই স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের দখলকৃত মুক্ত এলাকায় ঘটা করে ঈদুল-ফিতর উদযাপনের ব্যাপক আয়োজনের খবর ফলাওভাবে প্রচার করা হয়েছিলো।... ঈদুল-ফিতরের জামাত পরিচালনা করেছিলেন মওলানা দেলোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের ভোলা নিবাসী এই মওলানা আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কুরআন পাঠ এবং তাফসির করতেন বলেও জানা যায়।

এর বাইরে খুব একটা ঘটা করে ঈদ আনন্দ উদযাপিত হয়নি, তবে অনেকেই ভেবেছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী, অন্তত তাঁর অফিসে সামান্য হলেও ঈদের খাবার-দাবারের আয়োজন থাকবে। কিন্তু এদিন তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন একেবারেই নিরুত্তাপ। ঈদের নামাজ আদায়ের বাইরে অন্যসব আনুষ্ঠানিকতা থেকে বিরত থেকেছেন তিনি। ঈদের নূন্যতম আনন্দ থেকে বিরত রেখেছেন পরিবারকেও।

 

যে ঈদ সারাজীবন দিয়েছে আনন্দ, অতীতের সব দুঃখ-গ্লানি মুছে দিয়ে বয়ে আনতো আনন্দের বার্তা; ১৯৭১র ২০ নভেম্বরের সেই ঈদ ছিল তার উল্টো। সেই অসহায় সময়টিতে ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে তাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে দুইবার ভাবতে হয়নি ভারতের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে। একদিকে গণহত্যা অন্যদিকে মানবিকতা, বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত মানবিকতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলো, গণহত্যাকে রুখে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলো এবং সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্তিম বন্ধু হয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে ঈদ পালন করেননি মুক্তিযোদ্ধারা বরং দেশ স্বাধীন করে বিজয়ের ঈদ-উৎসব পালনের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সমগ্র জাতিই তখন যুদ্ধে শামিল। এরকম ঈদ মনে হয় জাতির জীবনে আর কখনো আসেনি। আতঙ্ক, দেশ স্বাধীন করার সংকল্প, শরণার্থী শিবিরে অনিশ্চিত জীবন এসব কিছু ঘিরেছিলো প্রতিটি মানুষের মন। রণাঙ্গনে ঈদের দিনেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চলছিল

লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

 

তথ্যসূত্র-  

১। স্বাধীনাতা আমার রক্তেঝরা দিন, বেগম মুশতারি শফি, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা, পঞ্চম সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠা- ২৭৮ ও ২৭৯।

২। প্রাগুক্ত- মুক্তিযুদ্ধের ঈদ, পৃষ্ঠা- ২৮ থেকে ২৯।

৩। একাত্তরের ঈদ- আসিফুর রহমান সাগর।

৪। একাত্তরের রণাঙ্গন: অকথিত কিছু কথা- নজরুল ইসলাম।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat