×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৫-২৫
  • ৬৬৬ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

আপনি ভারতীয় মুসলিম নাকি ভারতীয় খ্রিস্টান?  

এমন প্রশ্ন আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও এতে বড় আপত্তি রয়েছে ভারতীয় মুসলমানদের। অল ইন্ডিয়া ইমাম অরগানাইজেশনের প্রধান ইমাম ড. ওমর আহমেদ ইলিয়াসি এমনটাই মনে করছেন।

তারা বিশ্বাস করেন তাদের প্রথম পরিচয় হলো- তারা ভারতীয়। ধর্ম ও বর্ণ আলাদা হতে পারে, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও উপাসনার পদ্ধতিও আলাদা হতে পারে; তবে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হলো মানবতা এবং দ্বিতীয় ধর্ম ভারত! আমি একজন ভারতীয় এবং একজন ভারতীয় হিসেবে আমি গর্বিত। দয়া করে আমাকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করুন। আমি ভারতের প্রধান ইমাম, মুসলমানদের ইমাম নই। আমার প্রথম আপত্তি হচ্ছে আমাদের ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করবেন না। আমাদের ভারত ও ভারতীয়তার সঙ্গে যুক্ত করুন। জাতি সবার ওপরে।

এই বক্তব্যের সূত্র ধরে ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের ভাবনা চিন্তার দিকে নজর দিলে অনেক কিছুই আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। ভারত বর্তমান পৃথিবীতে সমাজ, সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও ইসলামী কালচারসহ অন্যান্য যেকোন দিক থেকে সবচেয়ে বৈচিত্রময় দেশ। বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর তালিকায় ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। অফিসিয়ালি ২০ কোটির উপর মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ভারতে। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠী বৈচিত্রপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি ধর্মপরায়ণও। ভারতে বিশ্বের বেশিরভাগ হিন্দু, জৈন এবং শিখ বসবাস করেন, এছাড়া কোটি কোটি খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও আবাসস্থল ভারত।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার ৭৬ বছরের মাথায় এসে ভারতীয়রা মনে করছেন , তাদের দেশ স্বাধীনতা-পরবর্তী আদর্শগুলোর অন্তত একটিকে সমুন্নত রাখতে পেরেছে: আর তা হলো ধর্মীয় স্বাধীনতা। ২০১৯ সালের শেষের দিক ১৭টি ভাষার প্রায় ৩০,০০০ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সরাসরি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ভারত জুড়ে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের নতুন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অধিকাংশ ভারতীয় তাদের ধর্মবিশ্বাস স্বাধীনভাবে অনুশীলন করতে পারে। পিউ রিসার্চ সেন্টার জানায়, ভারত এমন একটি সমাজ যেখানে একাধিক ধর্মাবলম্বীরা নির্দ্বিধায় জীবনযাপন ও ধর্মচর্চা করতে পারেন।  ভারতীয়রা ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে তাদের জাতীয়তার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে দেখেন। প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির বেশিরভাগ অনুসারী বলেছেন যে, সত্যিকারের ভারতীয় হতে গেলে সকল ধর্মকে সম্মান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং সহনশীলতা ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি একটি নাগরিক মূল্যবোধও: ভারতীয়রা সবাই একমত যে, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন তাদের নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার শর্তেরই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

পিউ রিসার্চ সেন্টার হল একটি নিরপেক্ষ ফ্যাক্ট ট্যাঙ্ক যা বিশ্বকে প্রভাবিত করা সমস্যা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রবণতাগুলো  সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে। এটি নীতিগত কোন অবস্থান গ্রহণ করে না। বিশ্বে রিসার্চ সংক্রান্ত তথ্যের ব্যাপারে পিউ রিসার্চ সেন্টারের বক্তব্যকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয়।

ভারতে সকল ধর্মের নাগরিকদের নির্দ্বিধায় ধর্ম পালনের ব্যাপারে পিউ রিসার্চ সেন্টার যে জরিপ উপস্থাপন করেছে  সেখানে দেখা যায়, ৮৯ শতাংশ মুসলমান মনে করেন তারা তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারছেন। ভারতের মুসলমানদের প্রায় ৯৫ ভাগ বলেছেন, তারা ভারতীয় হতে পেরে খুবই গর্বিত, এবং তারা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি প্রবল উৎসাহ প্রকাশ করেন: ৮৫ শতাংশ এই উক্তিটির সাথে একমত যে, ভারতীয়রা নিখুঁত নন, কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

এই জরিপের সত্যতা পাওয়া যায় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিলেও। ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের নিরাপত্তা নিয়ে অধিক ভয় বা শংকা থাকলে সেখানে দেশান্তরের ঘটনা ঘটতো কিন্তু এমন ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে ঘটলেও ভারতের ক্ষেত্রে ঘটছে না, বরং মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২২ লাখ ছিলো, মুসলিম বৃদ্ধির হার মাথায় নিলে সেই সংখ্যা এখন ২২ কোটিরও উপরে হবে। তবে এটাও অস্বীকারের উপায় নেই যে, ভারতে প্রায়শই ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের জন্য উগ্রপন্থীরা নানা অপরাধ করে কিন্তু ভারতবাসী সর্বদা তাদের প্রত্যাখ্যান করে।

আবারো ফিরে যাচ্ছি অল ইন্ডিয়া ইমাম অরগানাইজেশনের প্রধান ইমামের বক্তব্যে। ভারতে মুসলিমদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ড. ওমর আহমেদ ইলিয়াসি বলেন,

আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই। খুব বেশি দূরে যাব না। আমি কেবল আমাদের প্রতিবেশি দেশ চীনকে দেখিয়ে বলব- চীনের মুসলমানদের ইবাদতের স্বাধীনতা নেই। চীনের মুসলিমরা টুপি পরতে পারে না। দাঁড়ি রাখতে পারে না। রমজানে রোজা রাখতে পারে না। তাদের কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের স্বাধীনতা নেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্বিত। অন্যদিকে ভারতে সব ধর্মের মানুষকে সম্মান করা হয়। আমাদের দেশের বিশেষত্ব হলো অনেক ধরনের মানুষ মিলে মিশে একতাবদ্ধ জীবন যাপন করে। আমরা একে অপরের উৎসব উদযাপন করি। আমাদের একে অপরের মধ্যে স্নেহ আছে, আমরা একে অপরের ধর্মীয় স্থানে যাই। হিন্দুরা মসজিদে যায়, মুসলমানরা মন্দিরে যায়। এটা অন্য কোনো দেশে কি ঘটে? আমি এর বেশি কিছু বলতে চাই না।

ভারত উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে দীর্ঘকালের ভারতীয় সংস্কার দিয়েই। সময়ে অসময়ে সেখানে অনেক মৌলবাদী গোষ্ঠির উত্থান ঘটলেও ভারতবাসী সেটা প্রতিহত করেছে। সকল ধর্মের মানুষদের অধিকারকে সুরক্ষিত করার জন্য ভারতের সাধারণ জনগণ সর্বদা চেষ্টা চালিয়েছে।

লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat