প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
ভারত সফরে রাজনীতির বাইরে যে নামটি সবচেয়ে বেশি গণমাধ্যমে চর্চিত হয়েছে তা হলো
গৌতম আদানি। আদানি গ্রুপের মালিক গৌতম আদানির সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর
দিল্লিতে সাক্ষাৎ বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের একটা পক্ষ যথারীতি প্রোপাগান্ডা
করছে এবং নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা কেনো সাক্ষাৎ করলো এক ব্যবসায়ীর সাথে তা নিয়ে
নানারকম গল্প ফাঁদছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গৌতম আদানির সঙ্গে বৈঠক করেন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দিল্লি সফরের প্রথম দিনেই
যেভাবে সেই গৌতম আদানির সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হলেন, সেটাকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। স্বাভাবিক
অর্থেই এর কারণ অনুসন্ধানে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠে ভারত ও বাংলাদেশের মিডিয়া।
গৌতম আদানির সাথে বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সাক্ষাতের কারণ জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে এই গৌতম আদানি
কে? বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বা তার কোম্পানি কতোটুকু
প্রাসঙ্গিক। ভারতের যে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য এখন আফ্রিকা থেকে
অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত - তার কর্ণধার গৌতম আদানি। ধনসম্পত্তির বিচারে ভারতের এই শিল্পপতির অবস্থান বর্তমানে বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটের উপরে। ব্লুমবার্গ বিলিওনেয়ার র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের তিন
নাম্বার ধনী ব্যক্তি হলেন গৌতম আদানি। ধনসম্পত্তির বিচারে স্পেসএক্সের ইলন মাস্ক ও
অ্যামাজনের জেফ বেজোসের ঠিক পরেই তার স্থান। তবে গত তিনদিন আগের এক রিপোর্টে
দ্বিতীয় অবস্থানে গৌতম আদানির নাম দেখা গেছে। আদানি গ্রুপের অধীনে রয়েছে
মোট সাতটি কোম্পানি। বন্দর ব্যবস্থাপনা, কয়লা উৎপাদন এবং কয়লার ব্যবসা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন, গ্যাস সরবরাহ, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ, প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ সরঞ্জাম উৎপাদন, বিমানবন্দর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা,
আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহন, আবাসন, ভোজ্যতেল, খাদ্যপণ্য এরকম নানা খাতে ব্যবসা রয়েছে
কোম্পানিটির। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতসহ অনেক সেক্টরে বাংলাদেশেও বিনিয়োগ রয়েছে
আদানি গ্রুপের।
আদানি গোষ্ঠী বাংলাদেশে বিপুল
পরিমাণ লগ্নি করেছে - বিশেষ করে এনার্জি খাতে তারা অনেক বিনিয়োগ করেছে। আর
বাংলাদেশ এখন যেভাবে এনার্জি সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, লোডশেডিং যেভাবে বেড়ে গেছে - তাতে স্পষ্ট বাংলাদেশের এনার্জি কতটা দরকার।
তাই দেশের জন্য, মানুষের জন্য আদানি গ্রুপ একটা ভালো সহায়তা মাধ্যম হতে পারে। আবার
গত কয়েক বছরে আদানি শিল্পগোষ্ঠী যেভাবে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে - তা
প্রায় অভাবনীয়। বাংলাদেশের বাজারে মোড়কজাত সয়াবিন তেলের বড় বিক্রেতা আদানি
গ্রুপ। আমরা অনেকেই
হয়ত বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের
সয়াবিন তেল ব্র্যান্ড রূপচাঁদার নাম শুনেছি, এই রূপচাঁদা তেল এর মালিকপক্ষও আদানি
গ্রুপ। আবার এবছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সাথে
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একটি বিশেষ ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির চুক্তি করে
আদানি গ্রুপ-এর সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আদানি পোর্টস।
এদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
সাথে বৈঠকের পরপরই গৌতম আদানি এক টুইট বার্তায় লেখেন, "আমরা ২০২২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মধ্যেই আমাদের ১৬ শ মেগাওয়াট
গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং ট্রান্সমিশন লাইন চালু করতে বদ্ধ পরিকর।" এখানে
জেনে রাখা ভালো যে, আদানি গ্রুপের অন্যতম সহযোগী সংস্থা আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ড
রাজ্যের গোড্ডা এলাকায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এই কেন্দ্র
থেকেই বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ঝাড়খন্ড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য
আলাদা একটি সঞ্চালন লাইন তৈরি করেছে আদানি পাওয়ার। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময় এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা
হয়। ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডর সাথে চুক্তি হয়। তাই এমন এক পরিস্থিতিতে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আদানির সাথে সাক্ষাৎ বা গুরুত্ব দেয়াটা স্বাভাবিক।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
সাক্ষাতের পর আদানি গ্রুপ নতুন কিছু সেক্টরে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। জ্বালানি
খাতের পর এবার বাংলাদেশের নৌ পরিবহন, উন্নত প্রযুক্তির
জ্বালানি এবং সেবা খাতে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ভারতের শীর্ষস্থানীয়
ব্যবসায় গোষ্ঠী আদানি গ্রুপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লিতে সৌজন্য সাক্ষাতের
সময় আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি বিনিয়োগ নিয়ে আগ্রহের কথা জানান বলে
গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে। এছাড়াও নতুন কিছু সুযোগ বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছে আদানি গ্রুপের
মাধ্যমে। গৌতম আদানি তাঁদের বন্দরটি বাংলাদেশকে ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশ
এখন কলম্বো বা সিঙ্গাপুর হয়ে পণ্য পাঠিয়ে থাকে। ফলে সময় ও আর্থিক জায়গা বিবেচনায় আমাদের অনেকটা লস হয়। তিনি
ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য আদানির বন্দর ব্যবহার করতে বললেন। ফলে আর্থিকভাবে লাভবান
হবার সুযোগ আছে বাংলাদেশের। এছাড়া আদানি গ্রুপ বিদ্যুতের যে সঞ্চালন লাইন তৈরি
করেছে,
সেটার ধারণক্ষমতা বেশি। এবার তারা সোলার ও উইন্ড মিলে ব্লেন্ডেড
এনার্জির নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি অভিনব এবং ভালো। গৌতম আদানির এসব
প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ।
ভারত সফরে গিয়ে সেদেশের
ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের
সঙ্গে প্রতি বছর বাংলাদেশের ১০০০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য হয়ে থাকে। তবে
প্রতিবেশী দেশ হলেও বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ এখনো বেশ কম। তবে সেই পরিস্থিতি এখন
বদলে যেতে শুরু করেছে। একসময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সম্পর্কের কারণে ভারতীয়
বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসতে স্বস্তি বা নিরাপদ বোধ করতেন না। কিন্তু গত কয়েক
বছরে সেই প্রবণতা বদলেছে। এখন বিনিয়োগ বাড়ছে তবে বিনিয়োগ বাড়লেও তারা বেশি
গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন জ্বালানি, বাণিজ্যের মতো
তুলনামূলক নিরাপদ খাতে। আশা করা হচ্ছে সেই অবস্থাটাও শীঘ্রই কেটে যাবে। পোর্ট,
লজিস্টিকস, হাইড্রোকার্বন বা ক্লাইমেটের মতো
খাতে বাংলাদেশে ভারতেরর বিনিয়োগ যদি বাড়ে তাতে তো দুপক্ষেরই লাভ হবে সামনের
দিনে। তবে সেজন্য ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে, এখানে বিনিয়োগের পরিবেশ রয়েছে। অনেক জায়গায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে তা
দূর করতে হবে। জমির প্রাপ্যতার নিশ্চয়তা, অবকাঠামোর
উন্নয়ন- ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরতে হবে। ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করা গেলে
তারা হয়তো এগিয়ে আসতে শুরু করবে। সেটা দুই দেশের জন্যই একটা উইন-উইন সিচুয়েশন
তৈরি করবে। এদিকে ভারতীয়
বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে মোংলা এবং চট্টগ্রামে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল
গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের সরকার।
ভারত সফরে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আলাদা বৈঠক নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বড় মাইলফলক হতে যাচ্ছে। এই বৈঠককে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করছেন দু’দেশের পর্যবেক্ষকরা। ভারতীয় বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহের বিষয়টি যেমন এতে ফুটে উঠেছে তেমনি ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাও যে এখন স্বাচ্ছন্দ্যে বিনিয়োগের ব্যাপারে ভাবছে সেটাও পরিস্কার হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী-আদানি বৈঠক বাংলাদেশের তেল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখবে। ভারত বাংলাদেশ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন এক পথ উন্মুক্ত হবে।
লেখক-
-হাসান ইবনে
হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।