×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০২-২৮
  • ৪৭১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আলোচনাটা চলে হরহামেশা। একসময়কার বৃহ ভারতবর্ষেরই অংশ ছিল আজকের বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন নীতিতে। যেটি দ্বিজাতিতত্ত্বের অভিধায় অভিহিত। এই দ্বিজাতিতত্ত্বকে পাকিস্তান অনুসরণ করলেও ভারত সেক্যুলার রাষ্ট্রের ধারণায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাস তিক্ততায় ভরা। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূক আচরণ স্পষ্ট হয়ে পড়ে। বাঙালি জাতিকে একটি প্রজাসর্বস্ব জাতিতে পরিণত করা হয়। বাঙালির ওপর সীমাহীন নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাঙালি রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। রাজনীতির নানা ঘটনাপরম্পরায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয় বাঙালির। এই যুদ্ধ তথা স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি ভারতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনাটা সেখানেই।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। সম্পর্কের পারদ ওঠানামা করলেও বিগত ১৫ বছরে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এমন এক ভবিষ্যতের, যা সামগ্রিক সমৃদ্ধিকে বেগবান করবে। সম্পর্কের এই সোনালি অধ্যায়ে রচিত হবে গৌরবময় ইতিহাস। সম্পর্ক এখন ভিন্ন এক উচ্চতায় পর্যবসিত। কিন্তু তার পরও এ দেশে ভারতবিরোধী মনোভাবাপন্ন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একটা সময় ভারত বিরোধিতাই ছিল একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীর রাজনৈতিক অস্ত্র। অস্ত্রটি ব্যবহার করে ক্ষমতার স্বাদও গ্রহণ করেছে। যুগ বদলে গেছে ভারতবিরোধী অস্ত্র এখন আর আগের মতো কার্যকর নয়। তার পরও ভারতবিরোধী দৃষ্টিকোণ গড়ে উঠুক, এটা কখনো কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতার এতগুলো বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ভারত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে সম্প্রতি বেশ কিছু নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। আর এজন্যই সম্পর্কের নতুন যুগের সূত্রপাত। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে দেশ দুটি পরস্পরে সহযোগিতা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি পণ্যমূল্য পরিশোধের জন্য ভারতীয় রুপি ব্যবহারের নতুন চুক্তি করেছে দুই দেশ। ডলারের পাশাপাশি রুপিতে লেনদেন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। গত ১১ জুলাই থেকে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি এবং ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে মার্কিন ডলারের নির্ভরতা কমিয়ে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহার শুরু হয়েছে। ভারতীয় হাইকমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথ আয়োজনে রুপিতে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের উদ্ধোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুটি প্রতিষ্ঠানকে লেনদেনের সনদ তুলে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রানুযায়ী গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮ হাজার ২১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫৯ কোটি ডলারের পণ্য আসে শুধু ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় দুই দেশের মধ্যে। রুপিতে লেনদেন চুক্তির কারণে বাংলাদেশ এখন ২০০ কোটি ডলারের আমদানি দায় রুপিতে পরিশোধ করতে পারবে। এই ব্যবস্থাটি দুই দেশের সম্পর্কের ঘনত্ব আরো বাড়িয়ে দেবে।

এদিকে ভারতে অনুষ্ঠিত হওয়া জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সফরকালে মৈত্রী সুপার থার্মার পাওয়ার প্ল্যান্ট-২ এবং ৬৫ কিলোমিটার খুলনা-মংলা বন্দর রেলওয়ে লিংক উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। উল্লিখিত প্রকল্প দুটি ভারতীয় এলওসি (লাইন অব ক্রেডিট)-এর অধীনে বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় অনুদানে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের আখাউড়া এবং ভারতের আগরতলা রেলওয়ে লিংক। এদিকে ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যু আনার অনুমতি দিয়েছে ভারত। ভুটান থেকেও ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যু আমদানির অনুমতি দেবে বলে জানা গেছে। এগুলো দ্বিপাক্ষিক ভালো সম্পর্কেরই উদাহরণ। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যু সঞ্চালন কেন্দ্র দুটি আন্তঃদেশীয় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে প্রতিদিন ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যু আসছে। ভারতের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে ৫০০ মেগাওয়াট ও ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লা হয়ে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যু আসছে। এ তো শুধু পাওয়ার সেক্টরের বিষয়। ২০১৭ সালে শেখ হাসিনা নয়া দিল্লিতে চার দিনের সফরকালে দুটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভিন্ন কোনো দেশের সামরিক চুক্তি এটিই প্রথম। চুক্তি অনুসারে দুই দেশ যুগ্মভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও মহড়ার আয়োজন করতে পারবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সার্বিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই পারবে না এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে।’ বঙ্গবন্ধুই দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কেরও ছন্দপতন ঘটে। সেই জায়গা থেকে উত্তরণ ঘটাতে বহু সময় লেগে যায় আজকের অবস্থানে আসতে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে সম্পর্কের জায়গাটা এতটা মজবুত হয়েছে। তাই সম্পর্ক টেকসই করতে আরো অনেক দূর যেতে হবে। সম্পর্ক কেবল সরকার টু সরকার নয়, সম্পর্কে থাকবে জনগণের অংশগ্রহণ। এই অংশগ্রহণের মূল ভিত্তিটি সংস্কৃতি। ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে।

দুই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাষাগত, ঐতিহ্যগত এবং শিল্পকলায় অন্ত্যমিল রয়েছে। সংস্কৃতির অনুভূতির অভিন্নতা সম্পর্ককে টেকসই করবে। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মসূচিকে আরো ত্বরান্বিত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক জোট। ভারতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি প্রশমনে সংস্কৃতি বিকাশের বিকল্প নেই। সম্পর্কের নতুন এই যুগ দীর্ঘায়িত হবে এবং তা অটুট থাকবে অধিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষের যোগাযোগ বৃদ্ধিতে দুই দেশকেই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। সহজ করতে হবে ভিসা ব্যবস্থাকে। উদার ও নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে না পারলে সরকার টু সরকারের গভীর সম্পর্ক কোনো মূল্য বহন করবে না। সম্পর্ক যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে—এই অবস্থানের স্থিরতায় সংস্কৃতিপ্রেমী তৈরি করতে হবে উভয় দেশকেই, তবেই দুই দেশ সম্পর্কের সমান্তরালে চলতে সক্ষম হবে।  

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat