×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৫-০৭
  • ২৪৪ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে যেসব কবি-সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠিত করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক ও অভিনেতা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ষাটের দশকে বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধ করেছিলো। সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রবীন্দ্র চর্চা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালিদের রাজনৈতিক আন্দোলনের এক ভিত্তি হয়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা গান থেকে নিয়ে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নের কথা বলতে শুরু করেন।  তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ হয়ে উঠে বাঙালির প্রেরণার উৎস। কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বাংলাদেশে একদল ইচ্ছাকৃত অপপ্রচারে লিপ্ত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় সঙ্গিত নিয়ে বহু আগে থেকেই ইচ্ছাকৃত বিতর্ক তুলেছে একদল। জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে প্রশ্ন তুলে বারাংবার তারা আমাদের জাতীয়তাবোধের উপর আঘাত হেনেছে। অস্তিত্বের উপর আসা এই  আঘাতের জবাব দিতেই আজকের এই লেখা। 
অনেককেই মাঝেমধ্যে বলতে শুনি, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা...’ পরিবর্তন দরকার। জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এটি না থাকার পেছনে যে যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেন তা হলো, 
১। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুর থেকে নকল করে নেয়া।
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় আয়োজিত এক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন। তাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত তাঁর লেখা বা সুরের হতে পারেনা। 
৩। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ বিরোধী ছিলেন, বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকায় ছিলেন।
৪। বাংলা ও বাঙালির আবেগ এই গানে প্রতিষ্ঠা পায়নি।
বিরোধী পক্ষ থেকে আসা উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর আলোকেই আমরা এই বিতর্কের  বিস্তারিত জবাবটা দিতে চাই। এই লেখার প্রথম পর্বে আমাদের জাতীয় সঙ্গিতের সুর সত্যি নকল কীনা তা নিয়ে লেখবো! 
বীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে জাতীয় সংগীতের সুর নকলের অভিযোগ এনেছে একদল। তাদের দাবী জাতীয় সঙ্গীতের সুর গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুর থেকে নকল করা। অথচ গগণ হরকরার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই ব্যাপকভাবে জ্ঞাত ও মীমাংসিত। মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল পত্রিকাতে এই গানটি (জাতীয় সঙ্গীত) ছাপিয়েছিলেন। এবং তিনি স্পষ্ট করেই উচ্চারণ করেছিলেন এই গানের সুর বাউল গান থেকে নেয়া। কেননা গগণ হরকরার সুর মৌলিক কোন সুর ছিলো না, এর পুরোটাই ছিলো বাউল টিউন। আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ব্যক্তি যিনি সাময়িক পত্রিকায় গগণ হরকরার সেই গানের বাণী প্রকাশ করেছিলেন। যে সুর নকল করে আপনি অন্য গান রচনা করবেন, নিশ্চয়ই সেই সুরকে ফলাও করে প্রচার করবেন না! তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যদি নকল করার নূন্যত্বম উদ্দেশ্য থাকতো তবে সাময়িকীতে নিশ্চয়ই গগণ হরকরার গানের লাইন আনতেন না, গগণ হরকরাকে প্রকাশ্যে এনে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিতেন না! 
আবার অনেকেই তখনকার যুগের গান বা সুর লিপিবদ্ধের ব্যাপারে অজ্ঞাত, না জেনেই একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তখনকার দিনে রেকর্ডিং চালু ছিল না। তাই এলবামে কোনো সুরের উপর আজকের মত সুরকারের তকমা এঁটে দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল না। তবে রবীন্দ্রনাথ নিজ উদ্যোগে প্রতিটি গান রচনার ইতিহাসও লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। পাশ্চাত্য সুর থেকে যা নিয়েছেন সেটা সেভাবেই লিপিবদ্ধ, বাউল থেকে যেটা নেয়া হয়েছে সেটা বাউল সুর হিসেবেই লিপিবদ্ধ। আর এই লিপিবদ্ধের কাজে শান্তিদেব ঘোষের কাজকেই অথেন্টিসিটি দিয়েছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। বিশ্বভারতী কর্তৃক অনুমোদিত রবীন্দ্র সাহিত্য এভাবেই লিপিবদ্ধ আছে এবং রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবদ্দশায় কখনোই দাবী করেন নি ‘আমার সোনার বাংলা’ তাঁর মৌলিক সুর, নিজের সৃষ্টি করা সুর। বরং তিনি বার বার বলেছেন এটা বাউল সুর থেকে নেয়া এমনকি রবীন্দ্রনাথের সুর সংকলন বইয়েও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাউল সুর হিসেবেই উল্লেখ করা। আবার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটিও গগণ হরকারের মৌলিক সুর নয়, এটা বাউল সুর। তাই এই সহজ বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের কোন জায়গা নেই। 
তাই এই গানকে কেন্দ্র করে যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘লেখা-চোর’ বা ‘সুর- চোর’ বানানোর মতো সাহিত্যের জগতে ‘আপেক্ষিক তত্ব’ আবিষ্কার করছেন তাদের জন্য করুণা হয়! সত্যি বলতে কি, ‘রবীন্দ্রনাথ অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন’ বা ‘অন্যের সুর চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন’- এমনসব কথা এত অবিশ্বাস্য ও বালখিল্য যে, এগুলোর অসাড়তা বুঝতে কাউকে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রযন্ত্র মদদে বিশেষ গোষ্ঠী রবীন্দ্র বিরোধীতা করতো। যারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গানে জীবনকে উপলব্ধি করে, তাদেরকে এক ঘরে করার অপচেষ্টায় “রবীন্দ্র পূজারী” শব্দটি সৃষ্টি করা হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। সেখানে পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী স্বার্থ জড়িত ছিলো। ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা আসলেও আমাদের উপর থেকে পূর্বের ভূত এখনো সরেনি বা আমাদের দেশের বড় একটি অংশ এখনো পাকিস্তান ভাবধারার চিন্তা চেতনা থেকে সরে আসতে পারেনি। এখনো এই দেশে অনেক মানুষ পাওয়া যায় যারা হরহামেশা সেই গণহত্যাকারী পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেই। নানা ইস্যুতে ইনিয়ে বিনিয়ে পাকিস্তানপ্রীতি ধরে পরে। এখনো খেলার নামে এদেশের একদল পাকিস্তান দেশকে সমর্থন করে, এখনো এ দেশে ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ লেখা প্ল্যাকার্ড স্টেডিয়ামে দেখা যায়। এরকম হাজারটা উদাহরণ এখনো আমাদের সমাজে আছে যেটা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এই দেশে রবীন্দ্র বিরোধীতার নামে একদল সাম্প্রদায়িক চরিত্রের বহিপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। অপপ্রচারের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাইছে, চাইছে জাতীয় সঙ্গিতকে পরিবর্তন করতে। কিন্তু দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নাগরিকরা যতদিন আছে ততদিন তাদের এই আশা বাস্তবায়িত হবে না। কবিগুরুর জন্মদিনে এই আমাদের প্রত্যয় ও অঙ্গিকার। 

লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ,
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat