×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৬-২৫
  • ৩৭২ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

গত ২১ জুন তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্র যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এবারের সফরে বাইডেন সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। যা এর আগে অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি বলে কূটনীতিক সূত্রে বরাত দিয়ে গণমাধ্যম জানাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে এই অঞ্চলে ভারতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কোয়াড গঠন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের সাথে ভিন্ন অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্কে আছে এই দুই দেশ। ২২ জুন নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন এবং তাঁর সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন। পরদিন সফর নিয়ে ৫৮ অনুচ্ছেদের এক যৌথ বিবৃতি জারি করা হয়। যৌথ বিবৃতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয়ই উঠে আসে, বিশেষত প্রতিরক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা আলোচনায় অধিক গুরুত্ব পায়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের ওপর উভয় পক্ষ গুরুত্ব দেয়। বৈঠকের আগে ভারতের তেজাস জঙ্গি বিমান ইঞ্জিন যৌথভাবে নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক ও ভারতের হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকসের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়া ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল অ্যাটমিকস থেকে ৩১টি এমকিউ ৯-বি সশস্ত্র ড্রোন কিনবে তিন বিলিয়ন ডলারে। ড্রোনগুলো সংযোজিত হবে ভারতে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ভারতে তাদের জাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে মার্কিন সমর্থনের কথাও পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এয়ার ইন্ডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানি থেকে ১০০টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করায় উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেন।

 

তবে মোদির এ সফর ঘিরে এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষেরও অনেক আগ্রহ ছিলো। মোদির সফর-পূর্ববর্তী সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করবেন কিনা। গত ২০ জুন নয়াদিল্লিভিত্তিক হিন্দুস্তান টাইমস-এর এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টানাপোড়েন, এ বিষয়ে ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়েছে।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো কথা হয়েছে, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। সন্ত্রাসবাদ আর সেই সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে সামান্য উল্লেখ আছে শুধু ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া, ইন্দো-প্যাসিফিক, পূর্ব এশিয়াসহ আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে দুই সরকারের মধ্যে চলমান গভীর, গতিশীল পরামর্শ অনুষ্ঠানকে উভয় নেতা স্বাগত জানান এবং ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় ইন্ডিয়ান ওশেন ডায়ালগের উদ্বোধনী অধিবেশন নিয়ে তাঁদের আগ্রহ প্রকাশ করেন। সফরের আগে ঢাকার একটি থিঙ্কট্যাংকের ওয়াশিংটন কানেকশন জানিয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ওপর ভারতের কোনো লিভারেজ নেই। বিষয়টি তাই আলোচনায় আসবে না। আবার আমরা যদি যৌথ বিবৃতি দিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তুকে নির্ধারণ করতে চাই তবে তা সবসময় নির্ভরযোগ্য নাও হতে পারে। এর বাইরেও অনেক আলোচনা হয় যা দু পক্ষই প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই অনেকে মনে করছেন মোদি-বাইডেন আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। এই ধারণার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে কেননা মোদির সফরের পূর্বে বাংলাদেশ ইস্যুতে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে দুটি তথ্য দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। প্রথমত, বিশদভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের জন্য ভূমিকা রাখতে দ্বিধা করবে না। দ্বিতীয়ত, স্বার্থগুলো যখন এই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তখন ভারত সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার। বৈশ্বিক অঙ্গনের পাশাপাশি এই অঞ্চলেও যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ রক্ষায় ভারতের সঙ্গে কাজ করবে।

পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখ্য উপমুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার শাসনামলে আসামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী উলফার কাছে ১০ ট্রাক সামরিক অস্ত্র পাচার হচ্ছিল। এটি নিরাপত্তার মূল বিষয়। ওই সাংবাদিক এসব বিষয়ে এবং বিশেষ করে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যে সমস্যা সৃষ্টি করা উচিত নয়এমন প্রত্যাশার বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিক্রিয়া জানতে চান।

জবাবে বেদান্ত প্যাটেল ভারত ও মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ওঠার কথা নাকচ করেননি। আবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠেছে এমনটিও বলেননি।

বেদান্ত প্যাটেল বলেন, আমি দুটি বিষয় বলব। প্রথমত, বিশদভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের বিষয় এবং ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতে এবং ভূমিকা রাখতে দ্বিধা করবে না। তবে বিষয়টি যেহেতু অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমি এ কথাও বলব যে এসব লক্ষ্য অর্জনে ভারত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

মুখ্য উপমুখপাত্র আরো বলেন, উন্মুক্ত, সমৃদ্ধ, নিরাপদ, স্থিতিশীল ও স্থিতিস্থাপক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ও বিশ্ব গড়তে কাজ করার জন্য আমরা আমাদের ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর করার অপেক্ষায় আছি।

সফর পূর্ববর্তী বৈঠকে মূলত সিদ্ধান্ত হয় কী নিয়ে দুই দেশ আলোচনা করবে, বা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কোন বিষয়গুলো থাকবে। আর সে হিসেবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসার সম্ভাবনা ছিলো। কেননা নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে  যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে জ্যাক সুলিভানকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ বিনষ্ট হয় ও আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ভারতের এ স্পষ্ট অভিমত বাংলাদেশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দুই দেশের কূটনৈতিক মহলের খবর। ভারত সরকার সর্বদাই মনে করেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ যেমন নিরাপদ তেমনি ভারতের সেভেন সিস্টার্সও নিরাপদ। তাই এই অঞ্চলের নিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকেই সবচেয়ে বেশি দরকার ভারতের। আবার ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নেও শেখ হাসিনা অনড় কেননা সন্ত্রাসবাদ তা যে রাষ্ট্রেরই হোক তার ফলাফল খুব ভয়াবহ। এর প্রমাণ হিসেবে পাকিস্তান আফাগানিস্তানকে আমরা দেখছি। তাই এই অঞ্চলের নিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই, ভারত এই বার্তা পরিস্কারভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে বলে অনেকের অভিমত। 

লেখক -হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat