×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৭-১৭
  • ৬৩৯ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরকে ঘিরে এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষেরও অনেক আগ্রহ ছিলো।  মোদির সফর-পূর্ববর্তী সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করবেন কিনা।  সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন যেভাবে বাংলাদেশের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছে, এক বিচিত্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, সে ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি কি বাইডেনকে কিছু বললেন? কেউ কেউ বলছেন, এ বিষয়ে আলোচনা করার প্রশ্নই ওঠে না। বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে মোদি আলোচনা করতে যাবেন কেন? আবার অনেকে বলছেন, না, বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর।  আবার গত ২০ জুন নয়াদিল্লিভিত্তিক হিন্দুস্তান টাইমস-এর এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টানাপোড়েন, এ বিষয়ে ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু আসল সত্যটা কি? 
ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো কথা হয়েছে, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। সন্ত্রাসবাদ আর সেই সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে সামান্য উল্লেখ আছে শুধু ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া, ইন্দো-প্যাসিফিক, পূর্ব এশিয়াসহ আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে দুই সরকারের মধ্যে চলমান গভীর, গতিশীল পরামর্শ অনুষ্ঠানকে উভয় নেতা স্বাগত জানান এবং ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় ইন্ডিয়ান ওশেন ডায়ালগের উদ্বোধনী অধিবেশন নিয়ে তাঁদের আগ্রহ প্রকাশ করেন। সফরের আগে ঢাকার একটি থিঙ্কট্যাংকের ‘ওয়াশিংটন কানেকশন’ জানিয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ওপর ভারতের কোনো ‘লিভারেজ’ নেই। বিষয়টি তাই আলোচনায় আসবে না। 
আবার আমরা যদি যৌথ বিবৃতি দিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তুকে নির্ধারণ করতে চাই তবে তা সবসময় নির্ভরযোগ্য নাও হতে পারে।  এর বাইরেও অনেক আলোচনা হয় যা দু পক্ষই প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।  কারণ বাইডেন ও মোদির যখন বৈঠক হয়, তখন সেটা ঠিক আমাদের পাড়ার সকালের চায়ের আড্ডা নয় যে মোদি বাইডেনকে বলবেন ভিসা নীতি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেবেন না। আর বাইডেন মোদীর পিঠ চাপড়ে বলবে এটা বাঁ ওটা দিতে বলেন তাহলে আর স্যাংশান দেব না! মূলত সেখানে দুই ধরণের আলোচনা হয়ে থাকে।  একটি হলো, কূটনৈতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এবং অন্যটি হলো ওয়ান টু ওয়ান আলোচনা। 
এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, এবারে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে দুটি তথ্য দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। প্রথমত, বিশদভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের জন্য ভূমিকা রাখতে দ্বিধা করবে না। আর দ্বিতীয়ত, স্বার্থগুলো যখন এই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তখন ভারত সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার।  ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে এই তথ্য জানিয়েছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখ্য উপমুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগের সঙ্গে ভারত আছে কি না, তা জানতে চান এক সাংবাদিক। জবাবে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান থেকে কথা বলে। আর ভারত কথা বলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে।  ভারতকে বাংলাদেশ বিষয়ে বলার সুযোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাম্প্রতিক সময়ের আলোচনা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শাসন আমলে ভারতের আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফার জন্য ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানসহ সার্বিক নিরাপত্তার ঝুঁকির প্রসঙ্গ এসেছিল। এখানে আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে এই দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিষয়টি আসা আলাদা গুরুত্ব বহন করে।  মোদী-বাইডেন আলোচনাতেও দশ ট্রাক অস্ত্র প্রসঙ্গ এসেছে বলেও এক সাংবাদিকের তথ্যে উঠে এসেছে। যদিও এমন প্রশ্নকে আলাদাভবে উত্তর না দিয়ে কিছুটা এড়িয়ে গিয়েছেন বেদান্ত প্যাটেল। 
২০০৪ সালে চট্টগ্রামে জব্দ হওয়া ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আনার নেপথ্যে জড়িত ছিলেন বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ও তার ঘনিষ্ঠরা। ভারতের একজন সাবেক সিনিয়র সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের বিএনপি এবং তাদের মিত্র জামায়াতে ইসলামী ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা এবং এ ধরনের অন্য সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহের একটি গোপন প্রক্রিয়া চালিয়েছিল এবং কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে ছিলেন তারেক রহমান। ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ)’র সাবেক ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিংয়ের এই বক্তব্য বাংলাদেশের ভূ-খন্ড দিয়ে এ অঞ্চলে অস্ত্র চোরাচালান সম্পর্কে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (উলফা) নেতা অনুপ চেটিয়ার সাম্প্রতিক মন্তব্যের পরিপূরক।  উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া জানান, ২০০৪ সালের চট্টগ্রামে জব্দ দশ ট্রাক অস্ত্র সম্পর্কে জানতো সেই সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী এবং উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। জেনে শুনেই তারা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার এই অস্ত্র বাংলাদেশে খালাসের ব্যবস্থা করেছিলো।  শুধু তাই নয়, হবিগঞ্জ, হালুয়াঘাট, শ্রীমঙ্গল এবং ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন এলাকায় উলফার ক্যাম্প গড়ায় বিএনপি-জামায়াত সরকারের নীরব সমর্থন ছিলো।  সিংকে উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়া টুডে জানায়, বিএনপি-জামায়াত জোটের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করে এসব অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছিল।
ডিআইএ -এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ভারতীয় জেনারেল বলেছেন যে আসামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার করতে অস্ত্র সংগ্রহ চক্রান্তের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন উলফা কমান্ডার-ইন-চীফ পরেশ বড়ুয়া। সিং বলেন, ‘কিন্তু তিনি (পরেশ বড়ুয়া) (বাংলাদেশের) ডিজিএফআই এবং এনএসআই’র কিছু কর্মকর্তার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রে কাজ করছিলেন তারেক রহমান (বিএনপির বর্তমান ভারগ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) এবং তখন হাওয়া ভবন (বিএনপির রাজনৈতিক কার্যালয়) হিসাবে পরিচিত তার বন্ধুদের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
তাই বিএনপি তার কৃতকর্মের মাধ্যমেই  নিজেদের প্রমাণিত করেছে তারা জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের প্রশয়দাতা।  আঞ্চলিক সন্ত্রাস নির্মূল ও শান্তি স্থাপনে ভারতের সবচেয়ে পরীক্ষিত বন্ধু ও যোদ্ধা শেখ হাসিনা। তাই বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পলিসি হাতে নিয়েছে তাতে কোনভাবেই ভারত একমত না। তা তাদের কাজের মাধ্যমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এমনকি সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে দশ ট্রাক অস্ত্রের বিষয়কে টেনে আনার মাধ্যমেও ভারত এক বুদ্ধিদীপ্ত কূটনৈতিক খেলা দেখিয়েছে।  অনেকেই যদি মনে করে থাকেন ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে কোন বার্তাই দেয়নি তবে ভুলের মধ্যে আছেন। ভারতের আঞ্চলিক রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃংখলা বিশেষ করে সেভেন সিস্টার্স ইস্যুতে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু শেখ হাসিনা। তাই জঙ্গিবাদ নির্মূলে এবং আঞ্চলিক শান্তি স্থাপনে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ নেই এই বার্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবেই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

লেখক-হাসান ইবনে হামিদ,
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat