‘সন্ত্রাসবাদে
মদদ দেয়া রাষ্ট্র’ হিসেবে আরেকবার পাকিস্তানের নাম উচ্চারিত
হলো। হোয়াইট হাউজে গত ২৩ জুন দেয়া মোদি-বাইডেন যৌথ বিবৃতিতে দুই রাষ্ট্রনেতা পাকিস্তানকে
বার্তা দিয়েছেন, তারা যেন তাদের মাটিকে জঙ্গি ঘাঁটি হতে না দেয়। ভারত ও আমেরিকার তরফে
যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে সেখানে বাইডেন ও মোদি তীব্রভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের
ছায়াযুদ্ধের নিন্দা করেছেন। সেই সঙ্গে পাকিস্তানকে বলা হয়েছে তারা যেন দ্রুত পদক্ষেপ
করে নিশ্চিত করে যেন তাদের মাটিকে সন্ত্রাসী হামলার জঙ্গি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার না
করা হয়। এতে আরো বলা হয়, পাকিস্তানে যে সব জঙ্গি আছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন ইসলামাবাদ
ব্যবস্থা নেয়। বিবৃতিতে দুই দেশই সীমান্তপারের সন্ত্রাসের নিন্দা করেছে।
উল্লেখ্য, গত ২১ জুন তিনদিনের রাষ্ট্রীয়
সফরে যুক্তরাষ্ট্র যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এবারের সফরে বাইডেন সরকার
ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। যা এর আগে অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি
বলে কূটনীতিক সূত্রে বরাত দিয়ে গণমাধ্যম জানাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইন্দো প্যাসিফিক
স্ট্র্যাটেজির কারণে এই অঞ্চলে ভারতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কোয়াড
গঠন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের সাথে ভিন্ন অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্কে
আছে এই দুই দেশ। ২২ জুন নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে
ভাষণ দেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন এবং তাঁর সম্মানে
দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন। পরদিন সফর নিয়ে ৫৮ অনুচ্ছেদের এক যৌথ বিবৃতি জারি করা হয়। যৌথ
বিবৃতিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয়ই উঠে আসে, বিশেষত প্রতিরক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে
সহযোগিতা আলোচনায় অধিক গুরুত্ব পায়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা
রক্ষায় কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের ওপর উভয় পক্ষ গুরুত্ব দেয়। বৈঠকের আগে ভারতের তেজাস
জঙ্গি বিমান ইঞ্জিন যৌথভাবে নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক ও ভারতের
হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকসের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়া ভারতের প্রতিরক্ষা
মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল অ্যাটমিকস থেকে ৩১টি এমকিউ ৯-বি সশস্ত্র ড্রোন কিনবে
তিন বিলিয়ন ডলারে। ড্রোনগুলো সংযোজিত হবে ভারতে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ভারতে তাদের
জাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের অন্তর্ভুক্তির
বিষয়ে মার্কিন সমর্থনের কথাও পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এয়ার ইন্ডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং
কোম্পানি থেকে ১০০টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করায় উভয় নেতা সন্তোষ প্রকাশ করেন।
ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিক গুরুত্ব
দেয়া এবং যৌথ বিবৃতিতে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে উল্লেখ করাতে তেলেবেগুনে
জ্বলে উঠেছে পাকিস্তান। বিবৃতির পরই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মার্কিন ডেপুটি
চিফ অফ মিশনকে ডেকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে এই বিবৃতিকে অপ্রয়োজনীয়, একতরফা
ও বিভ্রান্তিকর বলা হয়েছে। পাকিস্তান
এও জানায়, আমেরিকা যেন এমন কিছু না করে, যার ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ভিত্তিহীন
ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক প্রচার গুরুত্ব পায়। পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে
বলা হয়েছে, আমেরিকার সঙ্গে তাদের সন্ত্রাসবিরোধী অপারেশন ভালোভাবে চলছে। পাক-মার্কিন
সম্পর্কও আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে কি কোন ভুল ছিলো?
চার দশক ধরে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদকে মদদ জুগিয়ে চলেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। শুধু
মুম্বাই হামলাই নয়, আমেরিকায় ৯/১১ হামলার ষড়যন্ত্রেরও আঁতুড়ঘর ধরা হয় পাকিস্তানকে।
২০০৫ সালে লন্ডন বিস্ফোরণে ৫৬ জনের মৃত্যু, ২০১৯ সালের লন্ডন ব্রিজে হামলা, ২০১৬ সালে
উরিতে আক্রমণের ষড়যন্ত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে পাকিস্তানের মাটি।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের বাণিজ্যিক
রাজধানী মুম্বাইতে আইএসআইয়ের মদদপুষ্ট জঙ্গিরা এক ভয়াবহ হামলা চালায়। তাজমহল হোটেলের
অতিথিরাই ছিলেন সেদিনের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। জঙ্গি হামলায় ৬ আমেরিকানসহ ১৬টি দেশের
মোট ১৬৬ জন নিহত হয়েছিল। গোটা দুনিয়ার সবাই জানে, হাফিজ সঈদের নেতৃত্বাধীন লস্কর-ই-তৈয়াবাই
মুম্বাইয়ের হোটেল তাজে হামলা চালায়। পুরো হামলার মূল মাথা ছিল হাফিজ নিজে।
অথচ মুম্বাই হামলার মূল হোতারা লাহোর হাইকোর্ট
থেকে মুক্তি পেলো। এতে কি প্রমাণিত হয়না, পাকিস্তান জঙ্গিদের এখনও মদদ জুগিয়েই যাচ্ছে।
আদালতে মুম্বাই হামলায় অভিযুক্ত ছয় জঙ্গির বিরুদ্ধে শক্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করেনি
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা। ফলে আলোচিত ওই হামলার মাস্টারমাইন্ড হাফিজ সইদের নিষিদ্ধ সংগঠন
জামাত-উদ-দাওয়ার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
আর লাহোর হাইকোর্টও তাদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মহলের সামনে পাকিস্তান বরাবরই
জঙ্গিদের পক্ষে অবস্থান নেয়। সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তান বা তাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের
মনোভাব বিন্দুমাত্র বদলায়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় জঙ্গিরা গোটা দুনিয়াতেই
জিহাদের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান এখনও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের
আঁতুড়ঘর। আর ইসলামাবাদ তাদের এমন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেটা বার বার গোটা দুনিয়াকে বুঝিয়ে
দিচ্ছে। বহুকাল ধরে জিহাদের নামে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকে মদদ জুগিয়ে চলেছে দেশটির
সেনাবাহিনী। কিন্তু সবকিছু জেনেও পশ্চিমা দুনিয়া পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে
কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ, ওসামা বিন লাদেন, খালিদ শেখ মোহাম্মদ, রামজি বিন আল-শিব,
আবু জুবায়দাহ, আবু লাইথ আল লিবি এবং শেখ সাইদ মাসরির কট্টর জঙ্গিবাদীরা পাকিস্তানেই
আশ্রয় নিয়েছিল।
সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পাকিস্তানের দ্বৈত চরিত্রের
কথা গোটা দুনিয়াই জানে। ২০১০ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন জঙ্গিবাদে
মদদের প্রশ্নে প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সতর্কও করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভসেও
সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পেশ করা
হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সন্ত্রাসের প্রশ্নে পাকিস্তানের
‘মিথ্যা ও প্রতারণা’র কড়া সমালোচনা
করে এক সময়। তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে পাকিস্তানি যোগসাজসের বিষয়টি গোটা দুনিয়ার
সামনেই উন্মুক্ত। তবু সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মদদ জুগিয়ে চলেছে পাকিস্তান। পারভেজ মোশাররফের
সময় থেকেই পাকিস্তানি সেনারা দেশের জন্য কাজ করার পরিবর্তে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণে বেশি
ব্যস্ত। আর তাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য
সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে চলেছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের মদদ দেওয়ার দীর্ঘ অভিযোগ রয়েছে। আমেরিকার বিশেষ অভিযানে নিহত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ‘শহীদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট জাতীয় পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এই আখ্যা দিয়েছিলেন। তাই ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বিবৃতিতে ভুল কিছুই ছিলো না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্রই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয়া ও মদদ দেয়া। জন্মলগ্ন থেকে এই দেশটি রাষ্ট্রীয়ভাবে জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে।
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।