গত ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সুরি শহরে ‘গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারা’র সামনে খালিস্তান আন্দোলনের নেতা হারদীপ সিং নিজ্জারকে হত্যা করা হয়। দু’জন মুখোশধারী ব্যক্তি তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। নিজ্জারের দেহে ৩৪ টি বুলেট পাওয়া গেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই ঘটনায় ভারতকে অভিযুক্ত করেছেন। খালিস্তানপন্থি
নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারত-কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্কে এখন
চরমভাবে টানাপোড়েন চলছে। আর এই টানাপোড়েনের মধ্যেই দিল্লির পাশে থাকার ইঙ্গিত দিলো
ঢাকা।
খালিস্তান আন্দোলন একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যার মাধ্যমে শিখরা পাঞ্জাব অঞ্চলে একটি আলাদা জাতি-ধর্মভিত্তিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবি করে। ভারতে এই আন্দোলন নিষিদ্ধ হলেও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী শিখরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করে চলেছেন। খালিস্তান আন্দোলনের একটি জঙ্গী সংগঠন খালিস্তান টাইগার ফোর্স। ভারত সরকারের দাবি, এই সংগঠনের প্রধান হারদীপ সিং নিজ্জার।
নিজ্জার হত্যায় ভারতকে দায়ী করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ট্রুডো বলছেন, কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ভারত সরকারের এজেন্টরা এই কানাডিয়ান নাগরিককে হত্যা করেছে। কানাডার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে ভারত সরকারের এজেন্ট এবং হত্যাকান্ডের মধ্যে সম্ভাব্য যোগসূত্র অনুসরণ করছে। তিনি বলেন, কানাডার মাটিতে কানাডার নাগরিককে হত্যা করা দেশের সার্বভৌমত্বের একটি অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন। কানাডার একটি ঊর্ধ্বতন সরকারি সূত্র জানিয়েছে, কানাডা এ ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের নেতাদের অবহিত করেছে, যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতির মাধ্যমে ট্রুডোর অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করে প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারত বলে,
এ ধরনের অপ্রমাণিত অভিযোগ খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী ও চরমপন্থীদের থেকে ফোকাস সরিয়ে দেয়। কানাডা এই সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দিয়েছে যা ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এ ঘটনায় দিল্লির পাশে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “ভারতের জন্য বাংলাদেশ খুবই গর্বিত, কারণ তারা অপরিপক্ক কিছু করে না। ভারতের সঙ্গে আমাদের খুবই দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সেটা মূল্যবোধ ও নীতির ওপর ভিত্তি করে গঠিত।”
তিনি বলেন,
ভারতের বিরুদ্ধে কানাডার সরকারের অভিযোগ একটি ‘দুঃখজনক পর্ব’ এবং তিনি বিষয়টির বন্ধুত্বপূর্ন সমাধান আশা করেন। ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া ২৩ সেপ্টেম্বরে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কানাডা খুনিদের আড্ডাখানা বা আশ্রয়স্থল হতে পারে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, খুনিরা কানাডায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেন ও সুন্দর জীবনযাপন করেন। একদিকে খুনিরা কানাডায় নিরাপদে রয়েছে, অন্যদিকে নিহতের পরিবারের লোকজন কষ্টে দিনযাপন করছে। বঙ্গবন্ধুর খুনীকে কানাডায় আশ্রয় দেয়া প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘তাদের (কানাডার) একটি আইন রয়েছে। সেটি হলো, যদি কোনো ব্যক্তি তার নিজ দেশে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিপ্রাপ্ত হন,
তাহলে কানাডার আইন অনুসারে, তারা সেই ব্যক্তিকে ফেরত পাঠাতে পারে না। আমরা কানাডা সরকারের কাছে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছি। দুর্ভাগ্যবশত, কানাডা আমাদের কথা শুনছে না, বরং বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে আসছে।’ তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কানাডার অবস্থান অপরাধীদের জন্য একটি প্রতিরক্ষা কবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় আত্মস্বীকৃত ও সাজাপ্রাপ্ত খুনি এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ১৯৯৬ সাল থেকে কানাডায় অবস্থান করছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার শেষ হওয়ার পর ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও কানাডায় আত্মগোপনে থাকা নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ওটোয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিবৃতিতে পাওয়া তথ্যমতে, কানাডার ইমিগ্রেশন বোর্ডে এই জঘন্য খুনির অপরাধকে ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ’ বলে অভিহিত করার পরও এই জঘন্য দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম খুনি নূর চৌধুরী বিগত ২৬ বছর ধরে কানাডায় আশ্রয় পেয়ে আসছে। নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানোর বিষয়টা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে একটি অমীমাংসিত বিষয় হিসেবে বিরাজমান রয়েছে। কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশন সাজাপ্রাপ্ত খুনী
নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাব্য সব বাধা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
কানাডার সনদের ৭ নং ধারা নিশ্চিত করে যে, প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। সুতরাং কোনো ব্যক্তিকে কানাডা থেকে প্রত্যর্পণের সময় যদি ব্যক্তির জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়, তাহলে তাদের জীবনের নিরাপত্তার আশ্বাস ছাড়া ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করতে পারে না। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সাল থেকে কানাডাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রদ করা হয়েছে । ২০০৮ সালে কানাডার সুপ্রীম কোর্ট রায় দিয়েছে, যদি কেউ অন্য দেশে অপরাধ করে,
তাহলে তাকে সেই দেশ যেমন উপযুক্ত মনে করে তেমন সাজা পেতে হবে। কানাডার শাস্তির মান প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু শাস্তি যেন মৃত্যুদণ্ড না হয় সেটি নিশ্চিত করতে কানাডিয়ান সরকারের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ খুবই স্বাধীন ও সরকার এতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। নূর চৌধুরী যদি বাংলাদেশে ফিরে আসেন,
তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তাদের প্রাণভিক্ষার আবেদন মঞ্জুর করে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তন করতে পারেন। এটা প্রেসিডেন্টের এখতিয়ার।
সুতরাং, অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই এবং ভূ-রাজনীতির সমীকরণগুলো অনুসরণ করেই ভারত-কানাডার মধ্যে চলমান টানাপোড়েনের এই কূটনীতিতে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু আত্মস্বীকৃত এবং সাজাপ্রাপ্ত খুনীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কানাডা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের কাছে তার ভরসার জায়গাটি হারিয়েছে। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর খুনীকে ফেরত দিলে অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।