×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০১-১০
  • ৮২১ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

গত ২৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২০’ প্রদান ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা অন্যের সহায়তা না নিয়ে আর্থ-সামাজিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আরো মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব নিয়েছি।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের অনুপ্রেরণার আলোকে তিনি আরো বলেন, ‘একটি বিজয়ী জাতি হিসেবে সারা বিশ্বে আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় মাথা উঁচু করে পদচারণ করব। যেহেতু আমাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে, আমরা ভিক্ষুকের মতো অন্যের কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাইব না।’

আমি ২০০৯ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সে সময় মালয়েশিয়া এবং সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তুন ড. মাহাথির মোহাম্মদসহ অনেক নেতাকেই গভীরভাবে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। সম্ভবত ১৯৯৯ সালে, বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে, আমার এক সপ্তাহের জন্য কুয়ালালামপুরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ১০ বছর পর ২০০৯ সালে আমি যখন দ্বিতীয়বার কুয়ালালামপুরে পৌঁছি, তখন কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শহরে যাওয়ার পথে চোখ-ধাঁধানো সব অবকাঠামো দেখে সত্যি অবাক হয়েছিলাম। ১৯৯৯ সালে দেখা মালয়েশিয়ার সঙ্গে বর্তমানের মালয়েশিয়াকে মেলাতে পারছিলাম না।   ওই পরিবর্তন অবশ্যই হঠাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটেনি। এর  পেছনে ছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি    ড. মাহাথির।

ব্যক্তিগতভাবে তুন মাহাথিরের সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি রাশিয়ার পিটার দ্য গ্রেট, জাপানের মেইজি সম্রাট, তুরস্কের মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক, দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুং হি এবং চীনের দেং জিয়াওপিংয়ের উচ্চ প্রশংসা করতেন। তাঁর মতে, এঁরা সেই সব ব্যক্তি, যাঁরা পরিবর্তন এনেছেন। তাঁরা যেখানে বসবাস করতেন সেই সম্প্রদায়কে পরিবর্তন করেছেন, আমূল পরিবর্তন করেছেন এবং আক্ষরিকভাবে তাঁদের একটি নতুন যুগে টেনে নিয়ে গেছেন। ড. মাহাথির বলতেন, মালয়েশিয়া সারা বিশ্বকে পথ দেখিয়েছে। আসলে তিনি আজকের মালয়েশিয়াকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছেন। তিনি আরো বলতেন, ‘যদি কেউ আপনাকে দিকনির্দেশ না দেয়, তাহলে প্রত্যেকেই সমস্ত জায়গা ঘুরে আসবে এবং কিছুই করা হবে না।’

শেখ হাসিনা সারা দেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, তা সহজেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমরা জানি আর্থ-সামাজিক খাতে অতীতে কিছুই করা হয়নি। এই ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার প্রশংসনীয় কার্যক্রম লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা বদলে দিয়েছে, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর  (দুর্বল, প্রান্তিক ইত্যাদি)

মালয়েশিয়ার জন্য মাহাথিরের অবদানের কোনো সীমানা ছিল না। ভালো হোক বা মন্দ, মাহাথির তাঁর দেশ ও জনগণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন। তাঁর কর্মের প্রভাব এতটাই দৃশ্যমান ছিল যে বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী সেখানে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন এবং মালয়েশিয়া বিশ্বের শীর্ষ ২০টি দেশের একটিতে পরিণত হয়। তিনি শিল্পায়ন বিস্তৃত করে মালয়েশিয়ায় এক আর্থ-সামাজিক বিপ্লব ঘটান।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দীপ্ত আহ্বানে পুরো বাঙালি জাতি তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য দখলদার পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁঁপিয়ে পড়েছিল। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন আমাদের নিরলস অনুপ্রেরণার উৎস, যা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ জুগিয়েছে এবং জনগণকে ধৈর্যসহকারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার সহ্য করার শক্তি দিয়েছে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে লাখো শহীদের রক্তধারায় জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনা বাঙালি জাতিকে এক ভয়াল অন্ধকারে নিমজ্জিত করে এবং আমরা, সদ্যোজাত বাংলাদেশের মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ি। বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধুলায় লুণ্ঠিত হতে থাকে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ভাই এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা যখন আততায়ীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন, তখন শেখ হাসিনা এবং তাঁর একমাত্র বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে ভারতে চলে আসেন এবং ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে মে মাসে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। এরপর ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার, ২০১৪ সালে তৃতীয়বার এবং ২০১৯ সালে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। অর্থাৎ তিনি প্রায় ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন। এককথায় তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী। আমার বিশ্বাস, এই সময়ে দেশ ও জনগণের জন্য তাঁর আকাশচুম্বী অবদানের কথা দেশের প্রত্যেক মানুষ ভালোভাবেই অবগত। তবে আমি এখানে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করব।

শেখ হাসিনা সারা দেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, তা সহজেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমরা জানি আর্থ-সামাজিক খাতে অতীতে কিছুই করা হয়নি। এই ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার প্রশংসনীয় কার্যক্রম লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা বদলে দিয়েছে, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর (দুর্বল, প্রান্তিক ইত্যাদি)। সেতু, উড়াল সড়ক, হাইওয়ে, মেট্রো রেল ইত্যাদির মতো যোগাযোগ খাতে বিশাল উন্নয়ন এরই মধ্যে পুরো দেশের চিত্রই বদলে দিয়েছে। দারিদ্র্যের হার অনেক হ্রাস পেয়েছে; যদিও এই হার আরো কমিয়ে আনতে হবে। প্রবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের জীবনযাত্রার মানে যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে; যদিও সেসবের গুণগত মানের আরো উন্নয়ন আবশ্যক। সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। বিদ্যুৎ খাতে তাঁর সরকারের রয়েছে এক অসাধারণ অর্জন এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করলে আমাদের অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে এবং জনজীবনেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষি খাতের উন্নয়ন দেশকে খাদ্যে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। তাঁর দূরদর্শী ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েও প্রযুক্তি খাতে পিছিয়ে নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা এখন একটি সুপরিচিত নাম, একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মানবতার একনিষ্ঠ জননী, শান্তির অদম্য প্রবক্তা এবং একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক।

ড. মাহাথির প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার মালয়েশিয়া সফর করেন। আমি মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রদূত থাকাকালে তিনি দুইবার মালয়েশিয়া সফর করেছেন। এ ছাড়া দুই নেতার মধ্যে দেশ-বিদেশে অনেক অনুষ্ঠানেই মতবিনিময় হয়েছে। সন্দেহ নেই যে মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া কিভাবে এত উন্নতি করেছে সেসব বিশদভাবে জানার সুযোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হয়েছে। তাঁর ওই অভিজ্ঞান বাংলাদেশে বাস্তবায়নের জন্য উৎসাহজনক কিছু হতে পারে। ড. মাহাথির ছাড়াও বিশ্বের অনেক নেতা রয়েছেন, যাঁরা তাঁদের জনগণ ও দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করেছিলেন।

রাজনীতিকে বলা হয় সম্ভব করার কৌশল বা দক্ষতা (আর্ট অব পসিবল)। রাজনীতিবিদদের অবশ্যই জানতে হবে কিভাবে তাঁদের দেশের ও জনগণের কল্যাণে অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করতে হয়। শেখ হাসিনা একজন রাজনীতিবিদ জন্মগতভাবেই এবং এরই মধ্যে তিনি প্রমাণ করেছেন যে সেই কৌশলের খুঁটিনাটি সবই তাঁর নখদর্পণে। তিনি তাঁর দেশ ও মানুষকে জানেন ও বোঝেন। তিনি তাঁর জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাশাপাশি বিশ্বের অর্থনৈতিক গতিবিধি সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল। বিশ্বশান্তি, মানবতা, উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাঁর অবদান ও নিষ্ঠাকে বিশ্বসম্প্রদায় অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে প্রশংসা করেছে। দেশের প্রতি রয়েছে তাঁর প্রশ্নাতীত প্রেম, উৎসর্গ-মনোভাব, সততা ও দৃঢ় অঙ্গীকার। হৃদয় ও মন থেকে তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। তাঁর ভাবনাজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি বাংলাদেশের জনগণের জন্য যেকোনো পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখেন। সত্যি বলতে, তিনি তঁঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি। সর্বোপরি তাঁর রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ দিকনির্দেশনাজ্ঞান, যা একজন নেতার জন্য দেশকে  সঠিক পথে নিয়ে যেতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্রোহী চীনা রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ইয়ান জিয়াকি একবার বলেছিলেন, ‘চীনে কেবল একজনই চিন্তা-ভাবনা করে।’ নির্বাসিত ওই ভিন্নমতাবলম্বী প্রথম চীনা সম্রাট থেকে দেং জিয়াওপিং পর্যন্ত সব নেতার এক দীর্ঘ তালিকার উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর মতে, রাজনীতিতে দেংয়ের ‘উভয় হাত সমান শক্ত হওয়া’ নীতি বর্তমানের চীনের বিকাশ সম্ভব করেছিল। বাংলাদেশকে আধুনিক রাষ্ট্রের মর্যাদায় উন্নীত করতে হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। আমার বিশ্বাস, সেই স্বপ্ন পূরণ করে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনগণের হৃদয়ে চিরদিন খোদিত হয়ে থাকবেন। বাঙালি জাতি অধীর আগ্রহে সেই দিনের অপেক্ষাই করছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat