×
  • প্রকাশিত : ২০২১-০২-১০
  • ১১০৩ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক
যুগে যুগে কিছু মানুষের জন্মই হয় অক্ষয় হওয়ার তরে। সাহস , দূর্জয় ও প্রতিজ্ঞায় তারা হয়ে ওঠেন অমর। তেমনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক সিকদার। তিনি একাধারে সমাজসেবী, সফল উদ্যোক্তা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। কর্মনিষ্ঠা এবং একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করে মানুষ যে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পারে জনাব জয়নুল হক সিকদার তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের এই বিশিষ্ট শিল্পপতি, সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক সিকদার আর নেই। পরাধীন দেশে স্বাধীন সূর্য এনে দেয়া বীর সৈনিক চলে গেছেন না ফেরার দেশে।২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, বুধবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।


জয়নুল হকের জন্ম ১৫ মে, ১৯৩৩ সালে ভারতের আসামে। পৈত্রিক নিবাস শরিয়তপুর জেলার মধুপুর গ্রামে। ছোটবেলা থেকে ডানপিটে সিকদারে ব্যবসার প্রতি ছিল দারুন আগ্রহ। তৎকালীন স্বনামধন্য ঠিকাদার পিতা চেয়েছিলেন ছেলে চাকরি করুক। পিতার আগ্রহে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেই যোগদেন আর্মিতে। টানা ১২ বছর আর্মিতে চাকরি করেন। কিন্তু ব্যবসার নেশা তখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে , তাই সেনা বাহিনীর চাকরি ছেড়ে মাত্র ১০০০ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন ট্রাকের ব্যবসা । পাকিস্তান আমলেই চার-পাঁচটি ট্রাকের মালিক হন তিনি। সিকদারের ব্যবসায়ী দক্ষতায় অভিভূত হয়ে পিতা ঠিকাদারি ব্যবসার সকল দায়িত্ব ছেলেকে বুঝিয়ে দিলেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে যুদ্ধের রণকৌশল তার জানা। এই সময় বসে থাকবার পাত্র নয় একসময়ের দুরন্ত সিকদার। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে চলে গেলেন যুদ্ধে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফের অধীনে প্রশিক্ষণ নিলেন। ঢাকা শহরে যুদ্ধের দায়িত্ব দেয়া হল । কিন্তু খালেদ মোশারফকে নিজের জেলা শরিয়তপুরে যুদ্ধের আগ্রহের কথা জানান সিকদার। আর কথা মত দেয়া হয় শরিয়তপুরের চারটি থানার দায়িত্ব। প্রায় ৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে নেতৃত্ব দিলেন তিনি। রণাঙ্গনে আক্কাস নামে একজন সহযোদ্ধার শহীদ হলে তার নাম অনুসারে গড়ে তুলেন ‘আক্কাস বাহিনী’। অদম্য সিকদারের নেতৃত্বে আগস্ট মাসেই শরীয়তপুর শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জীবন বাজী রেখে আগলে রাখেন মাতৃভূমিকে।
স্বাধীনতার পর আবার ব্যবসা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের বীরত্বের জন্য হয়ে উঠলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজনদের একজন। তৎকালীন শেখ মুজিব সরকার ১৭টি জেলায় গভীর নলকূপ বসানোর কাজ দায়িত্ব দেন সিকদারে হাতে। দেশ পুনর্গঠনের কাজে যুক্ত হন সিকদার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তিনি মনের দুঃখে এদেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে যান। সেখানেও রিয়েল এস্টেট ব্যবসার শুরু করেন। অল্প দিনেই পেলেন সাফল্য, হলেন আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশী ব্যবসায়ী। আশির দশকের শেষের দিকে দেশের মানুষের জন্য কিছু করবার লক্ষ্যে আবার ফিরে আসলেন বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠা করলেন সিকদার গ্রুপ অব কোম্পানিজ। একে একে ব্যাংক, গার্মেন্টস, রিয়েল স্টেট, এভিয়েশনসহ বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করলেন তিনি; হলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক।
পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই খ্যাতি ছড়িয়েছে তাদের মৃত্যুর পর। কিন্তু জয়নুল হক সিকদার এমনই একজন কিংবদন্তী যার খ্যাতি তার জীবদ্দশাতেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো, তিনি আলোকিত করেছেন দেশ বিদেশের লাখ লাখ পরিবার। হাসি ফুটিয়েছেন লাখ লাখ মা বাবার মুখে। এসব সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, একাধিক মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় নির্মাণ করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রম। ৮৮ বছরের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে লাল সবুজের পতাকা উড়বে ততদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক সিকদার থাকবেন বাংলার মানুষের অগ্রনায়ক হয়ে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat