ইমরান খান, বাইশ গজের তারকা ক্রিকেটার থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ
নিয়ে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে দ্বি-দলীয় শক্তির বাইরে গিয়ে
তৃতীয় শক্তির উত্থান হিসেবে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ইমরান খানের দল
তেহরিক-ই-ইনসাফ জয় লাভ করে। একপক্ষ মনে করেন, পাকিস্তানের
বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জনগণ ইমরান খানকে বেছে নেয়। আবার
আরেকপক্ষের দাবী, সেনা তোষণ নীতির কারণেই ইমরান খানকে
নির্বাচিত করা হয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের একবছর পর থেকেই বিরোধীরা রাজপথে আন্দোলনে
নামে, এর মাঝে করোনা মহামারি দেখা দিলে পাকিস্তানের সার্বিক
অর্থনীতি আরো খারাপ অবস্থায় চলে যায় এবং জন অসন্তোষ বাড়ে। এদিকে রাশিয়া কর্তৃক
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু হলে বিশ্ব রাজনীতিতেও ঘটে একটা বড় মেরুকরণ। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান দৃশ্যত অনেকটা হঠাৎ করেই রাশিয়া
বলয়ের দিকে ঝুঁকে যায়। জন অসন্তোষ এবং বিশ্ব রাজনীতি এই দুইয়ের মাঝে যখন আলোচনা
তুঙ্গে তখনই বিরোধীরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে
পার্লামেন্টে এক অনাস্থা প্রস্তাব আনে। ৩ এপ্রিল রবিবার অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত
হওয়ার কথা থাকলেও প্রস্তাবে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার রাজি না হওয়ায়
সেটি আর অনুষ্ঠিত হয়নি। অনাস্থা প্রস্তাবে যখন পরাজয় নিশ্চিত বলে অনেকেই মনে
করছিলেন তখন অনেকটা হঠাৎ করেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ডা. আরিফ আলভি
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা
দেন। এই অনাস্থা ভোটের পুরো বিষয়টা তখন চলে যায় সুপ্রীম কোর্টে। অনেক জল্পনা
কল্পনা শেষে সুপ্রীম কোর্ট অনাস্থা ভোট আয়োজনের পক্ষে মত দেন। ৯ এপ্রিল শনিবার
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে এই অনাস্থা ভোট আয়োজনের কথা থাকলেও অনেক নাটকীয়তার পর
রাতে অনাস্থা ভোট আয়োজিত হয় এবং বিরোধীরা ১৭৪ ভোটে পরাজিত করে ইমরান খানকে।
মধ্যরাতে ঘটে ইমরান খানের পতন।
ইমরান খানের এমন পতন
নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের ভঙ্গুর রাজনীতি, সেনাশাসিত রাজনীতি, বিদেশী শক্তির কাছে
বরাবরই পাকিস্তানের নতজানু ও দাসত্বের রাজনীতিকে আরেকবার ফুটিয়ে তুলেছে। ইমরান খান
ততোদিনই ক্ষমতায় থেকেছেন যতোদিন সেনাবাহিনী চেয়েছে, ইমরান খান ততোদিনই ক্ষমতায়
থেকেছেন যতোদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে! এগুলো কিন্তু এখন আর অভিযোগ নয় বরং
বাস্তব সত্য। পাকিস্তানের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার বক্তব্যেই
স্পষ্ট করে গিয়েছেন নিজের পতনের ব্যাপারে। তিনি স্পষ্টভাষায় মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। তিনি প্রকাশ্যেই বেশ কয়েকবার বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া সফরে যাওয়ায় একটি ক্ষমতাধর দেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতে দুই দিনের (২৩–২৪ ফেব্রুয়ারি)
সফরে মস্কোয় যান ইমরান খান। ঠিক সেই সময়টিতেই (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাশিয়া ইউক্রেনে
সামরিক অভিযান চালায়। ওই সময় রাশিয়া সফরে না যেতে যুক্তরাষ্ট্র ইমরানকে অনুরোধ
করেছিল বলেও জানিয়েছেন মি খান। তবে সরাসরি আমেরিকা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত বলে তিনি
উল্লেখ করেছেন গত ৩১ মার্চ। গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ইমরান খান এই
দাবী করেন। সেই ভাষণে এক ‘হুমকির
চিঠি’ নিয়ে কথা বলেন তিনি। একপর্যায়ে দৃশ্যত
তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেন, ‘ওই চিঠির
পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে।’ এর পরপরই
নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘এটি
যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্য কোনো দেশ।’ অনাস্থা
প্রস্তাব নিয়ে যখন পাকিস্তানের রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত, তখন হুমকির ওই চিঠি আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। ইমরান খান চিঠিটিকে তাঁর
সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিদেশি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে দাবি করেছেন। ৩ এপ্রিল
তিনি এই ‘বিদেশি ষড়যন্ত্রে’ জড়িত
মার্কিন কূটনীতিকের নাম সরাসরি জানালেন। ইমরান দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ডোনাল্ড লু সেই ব্যক্তি, যিনি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত। পাকিস্তান
তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতাদের এক বৈঠকে ইমরান বলেন, বিরোধীদের দিয়ে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব এনে সরকার পতনের লক্ষ্যে যে
বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছিল, তাতে জড়িত ছিলেন ডোনাল্ড লু। তবে
ইমরানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার দাবি নাকচ করেছে
যুক্তরাষ্ট্র। তার মানে পাকিস্তান রাষ্ট্র যে বিদেশী শক্তির ইশারায় চলে তা এখন
প্রমাণিত সত্য।
ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতি ও
দেশ পরিচালনার ব্যাপারে তুলনামূলক বিচার
বিশ্লেষণ করলে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দুই দেশের অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। এক দেশ
সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং গণতন্ত্রের আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে, অপরদিকে
ঠিক উল্টো অবস্থানে আছে পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে
কোন গণতান্ত্রিক সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেন নি। অর্থাৎ পাকিস্তানের এই
রুগ্ন দশার বিপরীতে ভারতের সফল গণতান্ত্রিক পথচলা। আর এই সফলতা ও বিদেশী
প্রভাবমুক্ত হয়ে এগিয়ে চলা ভারতকে এখন কুর্ণিশ জানাচ্ছে পাকিস্তানের
রাষ্ট্রপ্রধানও। আর সেকারণেই তো বিদায়কালে ইমরান খানের মুখেও ছিলো ভারত বন্দনা।
তিনি বলেন,
‘আজ আমি
ভারতকে স্যালুট জানাই। ভারতের বিদেশ নীতি সবসময়ই একটি স্বাধীন চিন্তা রেখেছে। ভারত
কোয়াড অ্যালায়েন্সের সদস্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
তার অন্যতম সদস্য। কিন্তু তবুও ভারত নিজেকে নিরপেক্ষ বলে। নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে ভারত। কারণ ভারতের বিদেশ নীতি সেদেশের জনগণের জন্য।‘
ভারত তার বিদেশনীতির ক্ষেত্রে
সবসময়ই নিজ দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও
ভারতের অবস্থান ছিলো পরিস্কার। বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক কৌশলে ভারত নিজ দেশের মানুষের
স্বার্থ আদায়ে কাজ করেছে। মার্কিন সতর্কতা সত্ত্বেও নিজ দেশের জনগণের স্বার্থে
যুক্তরাষ্ট্রের কোন ধরণের বক্তব্যকে
পাত্তা না দিয়ে রাশিয়া থেকে কম দামে বেশি তেল কিনছে ভারত। ইউক্রেনে
যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে
যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস কেনার
ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য দেশগুলোকেও প্রতিশোধমূলক নিষেধাজ্ঞার বার্তা দিয়ে আসছে
যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে না। ফলে
স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে রাশিয়া। তাই লাভের আশায়
মার্কিন হুমকি উপেক্ষা করেই দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত
রেখেছে ভারত। এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, রাশিয়ার তেল কেনা এড়াতে আমেরিকার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। দেশটি
জানায়, জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের নির্ভরতা ‘রাজনীতিকরণ’ করা
উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রও অগত্যা এই যুক্তি মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ, ভারত সরকার তার কূটনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে আমেরিকার মুখও বন্ধ করে দিয়েছে
আবার নিজ দেশের জনগণের স্বার্থে কম দামে বেশি তেলও কিনে রাখছে। এমন সাহসী ও
বিচক্ষণ পদক্ষেপের জন্য শুধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই না বরং বিশ্বের অন্যান্য
দেশ থেকেও মোদী সরকার বাহবা পাচ্ছে। অপরদিকে রাশিয়া ইউক্রেন পরিস্থিতি পাকিস্তানের
রাজনীতিকে এতোটাই প্রভাবিত করেছে যে, ইমরান সরকারের পতন পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে এই
যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানী জনতার একটা বিরাট অংশ মনে করে, ইমরান সরকারের
পতনের পেছনে আমেরিকা দায়ী। দৃশ্যমান রাজনীতিতে জনতার এই দাবীকে উপেক্ষাও করা যায়
না! তাছাড়া সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরাসরি তার পতনের জন্য
পাকিস্তানের বিদেশ নীতির দিকেও আঙুল তুলেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে
ইমরান খান এক জনসভায় বলেন,
‘পাকিস্তানের
বিদেশ নীতি এমন হবে যাতে দেশের মানুষের উপকার হয়। কারও সামনে কখনও নত হইনি। দেশেরও
মাথা নিচু হতে দেব না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সমর্থন চেয়েছিল।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা শুনে পাকিস্তানের কোনও লাভই হবে না। আমরা
আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধের অংশ হয়েছি এবং ৮০ হাজার মানুষ
এবং ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছি।‘
অর্থাৎ পাকিস্তানের বিদেশ নীতি
যে বিদেশী শক্তি দ্বারা প্রভাবিত সেটা পাকিস্তানীদের বক্তব্যেই স্পষ্ট। ইমরান
খানের পতন সেই বক্তব্যকে আরো বেশি জোরালো করলো।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে
রাজনীতি, অর্থনীতি সর্বোপরি মানব উন্নয়ন সূচকের প্রায় প্রতিটি ধাপে পাকিস্তানের
অবস্থা খুব নাজুক। পাকিস্তান এমন এক অবস্থায় আছে যা সেনা ও বিদেশী শক্তির কাছে
জিম্মি। এই জিম্মিদশার বিপরীতে ভারতের শক্তিশালী গণতন্ত্র ও সুসংহত অবস্থার
প্রশংসা এখন পাকিস্তানের মানুষের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বক্তব্যেও মুক্ত ও স্বাধীন ভারতের বিপরীতে বন্দী পাকিস্তানের হাহাকার ছিলো দৃশ্যমান! এই হাহাকার
কবে শেষ হবে তা জানেনা পাকিস্তান। তবে ভারত জানে, ঠিক কিভাবে নিজ দেশের মানুষের
স্বার্থে বিদেশ নীতি প্রণয়ণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। ভারতের সুসংহত গণতন্ত্র
ও বিচক্ষণ কূটনীতি বরাবরই এর প্রমাণ রেখেছে।
লেখক- হাসান ইবনে হামিদ,
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক