দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর
ভারত-বাংলাদেশ এর মধ্যকার যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৩
আগস্ট নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে প্রথম দুদিন সচিব পর্যায়ের এবং শেষদিন
মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিনের সফরে আগামী ৫
সেপ্টেম্বর ভারতে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরের আগে এই বৈঠক দুই
দেশের জন্যই অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। জেআরসিতে আলোচনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ
সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই করার চেষ্টা করা হবে বলে জানায় দু’পক্ষই।
সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির
বিন আনোয়ার এবং ভারতের পক্ষে দেশটির জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব পঙ্কজ কুমার
নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেআরসি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব
দিয়েছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক আর ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব
দিয়েছেন দেশটির পানিসম্পদমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং সিখাওয়াত। এই বৈঠকে এমন কিছু
ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যা দুই দেশের পানিবন্টন প্রক্রিয়ার এক মাইলফলক অর্জন
হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বৈঠকে দুদেশের অভিন্ন ৫৪টি নদী নিয়ে অমীমাংসিত ইস্যু,
সিলেটের কুশিয়ারা নদী থেকে শুকনো মৌসুমে পানি উত্তোলন, ত্রিপুরার সাবরুম শহরের
খাবার পানির চাহিদা মেটাতে ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলন চুক্তি কার্যকর, গঙ্গার
পানিবন্টন চুক্তি নবায়ন ও তিস্তা চুক্তিসহ আনুষাঙ্গিক সকল বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রতিবছর জেআরসি’র
বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারেও একমত হয় দুই দেশ।
দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান
৫৪টি অভিন্ন নদী নিয়ে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত
সফরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসবে। অন্তত এমনটাই মনে করা হচ্ছে এই বৈঠকের পর।
ইতোমধ্যে দুই দেশ যেকয়টি বিষয়ে ঐক্যমত হয়েছে তা বলতে গেলে যুগান্তকারী। আন্তঃনদী
সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি বিভিন্ন সংযোগ খালের
মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলীয় শুষ্ক নদীগুলোতে সরবরাহ করে সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে ভারত। তবে এখন
থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে হিমালয় থেকে প্রবাহিত কোনো নদীর পানি সরাবে
না দেশটি। বৃহস্পতিবার দিল্লিতে শেষ হওয়া যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে এই প্রতিশ্রুতি
দিয়েছে তারা।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে
প্রবহমান ছয়টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তির আলোচনা দ্রুত শেষ করতে চায় সরকার।
এই নদীগুলো হলো মনু, মুহুরী, খোয়াই,
গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার। ইতোমধ্যে এই ছয় নদীর
পানি বণ্টনের জন্য তথ্য-উপাত্তও বিনিময় করা হয়েছে। ২০১১ সালে এ ছয়টি নদীর স্থায়ী ও
দীর্ঘমেয়াদি পানি বণ্টনের জন্য আলোচনা শুরু হয়। পাঁচটি বৈঠকে কাঠামো চুক্তির
প্যারামিটার ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা হয়। প্যারামিটারের মধ্যে নদীর পানি
অন্যদিকে প্রবাহিত করার কাঠামো, পানি পরিমাপের স্থানের বিষয়ও
উল্লেখ আছে। এ ছয়টি নদীর মধ্যে একাধিক নদীর পানি অন্যদিকে প্রবাহিত
করার জন্য কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ছয়টি নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে এবারের বৈঠকে
আলোচনা হয়েছে। এছাড়া আরও আটটি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা চলছে।
এবারের বৈঠকে অভিন্ন নদীর
পানিবণ্টন ও যৌথ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও আটটি নদী চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো হলো
মহানন্দা,
সারি–গোয়াইন, হাওড়া, সোমেশ্বরী, জাদুকাটা,
জালুখালী–ধামালিয়া, ঢলাই ও পিয়াইন। এই নদীগুলোর মধ্যে মহানন্দা পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি–জলপাইগুড়ি
হয়ে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তারপর আবার বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ
হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। সারি–গোয়াইন
নদী মেঘালয় দিয়ে সিলেটে মিশেছে সুরমায়। কয়লাখনি ও সিমেন্ট কারখানার দূষণ সহ্য
করতে হচ্ছে এই নদীকে। এবারের বৈঠকে অভিন্ন নদীগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ জোর
দেওয়া হয়েছে। সোমেশ্বরী, জালুখালি–ধামালিয়া, জাদুকাটা ও পিয়াইন নদীও বাংলাদেশে ঢুকেছে মেঘালয় থেকে। ফেনীর মতো ত্রিপুরা
থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে হাওড়া ও ঢলাই নদী। বাংলাদেশে এসে হাওড়া মিশেছে তিতাস নদীতে,
ঢলাই মিশেছে মনুতে। পানিবণ্টন চুক্তির কাঠামোর মধ্যে আগের নদীগুলোর
সঙ্গে এই আটটি নদীও যুক্ত হচ্ছে। আপাতত এই নতুন নদীগুলোর পানি প্রবাহসহ যাবতীয়
তথ্য–উপাত্ত দুই দেশ একে অন্যের সঙ্গে
আদান–প্রদান করবে। নতুন এই আট নদীর খুঁটিনাটি
বিষয় জেআরসির নদী বিশেষজ্ঞরা (টেকনিক্যাল কমিটি) বিবেচনা করবেন।
এছাড়া কুশিয়ারা নদীর ১৫৩
কিউসেক পানি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। কুশিয়ারা নদীর পানি এখন বাংলাদেশের জন্য খুব
বেশি দরকার কেননা সিলেটে পাঁচ হাজার একর জমি চাষাবাদের জন্য একটি সেচ প্রকল্প হাতে
নিয়েছে সরকার। এজন্য কুশিয়ারা থেকে শুকনো মৌসুমে ১৫৬ কিউসেক পানি
উত্তোলন করতে চায় বাংলাদেশ। ভারতও সমপরিমাণ পানি উত্তোলন করবে। এ ব্যাপারে একটা
খসড়া এমওইউ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ সংক্রান্ত এমওইউ সই হতে পারে।
অন্যদিকে ফেনী নদীর পানি
মানবিক কারণে বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। ত্রিপুরার সাবরুম শহরের খাবার
পানির চাহিদা মেটাতে ফেনী নদী থেকে এক দশমিক আট কিউসেক পানি উত্তোলন করার চুক্তি
দুই দেশের মধ্যে আগেই হয়েছে। এই চুক্তি কিভাবে কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে জেআরসি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিকতার
খাতিরে ত্রিপুরার সাবরুম শহরবাসীদের পানের জন্য ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি
দিতে আগেই রাজি হয়েছিলেন। কুশিয়ারার সম্ভাব্য পানি প্রত্যাহার সমঝোতা দুই দেশের
সম্পর্কের দৃঢ়তারই পরিচয়। দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক এই পারস্পরিক দেওয়া–নেওয়ার
ভিত।
আকস্মিক বন্যার কবলে প্রায়শই
বাংলাদেশকে পরতে হয়। এতে জনজীবন যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হয় তেমনি সরকারকে বন্যা
পরবর্তী অবস্থা সামাল দিতে হয়। এবারের বৈঠকে বন্যার বিষয়ে পাঁচ দিন আগেই
পূর্বাভাস জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। এছাড়া তিস্তা চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন
করতে ভারতীয় পক্ষকে বলা হয়েছে। তারা চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তিস্তার
বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৯৬
সালে ২৫ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সই হয়েছিল। এ চুক্তিতে গঙ্গার পানি সর্বোচ্চ
ব্যবহারের জন্য সমীক্ষার কথা বলা হয়েছে। সমীক্ষার জন্য উভয় দেশ নতুন করে যৌথ
কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। জেআরসি বৈঠকে এই কমিটির কর্মকাণ্ড শুরুর ওপর গুরুত্ব
দেয়া হয়েছে। ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা নবায়নের জন্য উভয় দেশ
প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলাদা কোনো কথা বলা হয়নি বলে
জানানো হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এই চুক্তি নবায়নের আগে
বাংলাদেশে আবার এই ইস্যুতে ভোট হবে।
ভোটের পর এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করা যাবে বলে বাংলাদেশ মত দিয়েছে।
১৯৭২ থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে জেআরসির বৈঠক হয়েছে মোট ৩৭ বার। এরপর দীর্ঘ এক যুগের বিরতি। কোনো না কোনো কারণে এই ১২ বছর জেআরসির বৈঠক বসেনি। অবশেষে গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট ৩৮তম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। বন্ধ বৈঠক নতুনভাবে শুরুর বিষয়টির গুরুত্ব মেনে নিচ্ছে দুই দেশ। অভিন্ন ৫৪টি নদ–নদীর মধ্যে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে পূর্ণ হবে। তিস্তা চুক্তি স্থিমিত, কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহার নিয়ে বোঝাপড়া আসন্ন। এই ৪টি নদীর বাইরে যৌথ ব্যবস্থাপনা ও পানিবণ্টনের আওতায় রয়েছে মনু, মুহুরী, দুধকুমার, ধরলা, খোয়াই ও গোমতী। সব মিলিয়ে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে ১০টি নদী। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরও ৮টি। এটা অবশ্যই অগ্রগতি। এভাবে একদিন সব অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা চূড়ান্ত হবে। সে জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর জেআরসির বৈঠকে বসার ওপর দুই দেশই জোর দিয়েছে। দুই দেশ প্রতিবছর বৈঠকে সম্মতও হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই দুই দেশ তার অমীমাংসিত সকল বিষয় সমাধা করবে।
লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ,
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।