গত ১২ থেকে ১৩ মে বাংলাদেশে আয়োজিত হয়ে
গেলো ‘৬ষ্ঠ ভারত মহাসাগর
সম্মেলন ২০২৩’। "শান্তি,
সমৃদ্ধি এবং একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য অংশীদারিত্ব" শীর্ষক প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ষষ্ঠ বারের মত এই সম্মেলনের আয়োজন
করেছে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলকে শক্তিশালী করতে রোডম্যাপ চার্ট করার জন্য মূল স্টেকহোল্ডারদের
এক উজ্জ্বল সমাবেশ ছিলো এবারের এই সম্মেলন। ভারত মহাসাগর সম্মেলন (আইওসি) ২০১৬ সালে
শুরু হয় এবং গত ছয় বছরে এটি আঞ্চলিক ইস্যুতে এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য ‘ফ্ল্যাগশিপ কনসালটেটিভ
ফোরাম’ হিসাবে আবির্ভূত
হয়েছে। মরিশাসের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ২৫টি দেশের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী
পর্যায়ের প্রতিনিধি ছাড়াও ডি-৮, সার্ক ও বিমসটেকের প্রতিনিধিসহ প্রায় ১৫০ জন বিদেশি
অতিথি এ সম্মেলনে অংশ নেন। আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল
থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের বহু দেশ একত্রিত
হয়েছে এই সম্মেলনে। এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলি এবং প্রধান সামুদ্রিক অংশীদারদের
একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়েছে সবাই। সকলের জন্য সুরক্ষা ও প্রবৃদ্ধির জন্য
আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্ভাবনাগুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে সম্মেলনে।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এই সম্মেলনকে মূলত
নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারত। সম্মেলনে চিন বা মিয়ানমারের আমন্ত্রণ না পাওয়া অনেক প্রশ্নের
যেমন জন্ম দিয়েছে তেমনি ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণকেও অনেকটা স্পষ্ট করে দিয়েছে। আবার এমন
এক সময়ে বাংলাদেশে ষষ্ঠ ভারত মহাসাগর সম্মেলন হলো যখন বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে
একটি 'ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক' নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ মূলত ভারসাম্যমূলক নীতিকে
গ্রহণ করেছে তবে এক্ষেত্রে ভারতের সাথে সম্পর্কের
কোন অবনতি যেন নাহয় সেদিকে অনেক বেশি সতর্ক ছিলো বাংলাদেশ। অবশ্য বিগত একযুগ শেখ হাসিনার
নেতৃত্বে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এমন উচ্চতায় গিয়েছে যেখানে এমন কোন ভুল বুঝাবুঝির কোন
স্থান নেই। বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার
নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করেছে এবং কোনও রাজনৈতিক
ব্লকে যোগদানের পরিবর্তে নিজস্ব অবস্থানে রয়েছে। তাই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোটের
সক্রিয় সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক এই সম্মেলনে আস্থার জায়গাকে আরো বাড়িয়ে
তুলবে।
এই অঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে আমেরিকাও।
ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনে ডেপুটি সেক্রেটারি
শেরম্যান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছে সেখানে এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি
বলেন, ‘এ অঞ্চলে যা ঘটবে
তার মধ্য দিয়েই অনেকাংশে বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।‘ অবশ্য তিনি খুব
একটা মন্দ বলেন নি! কারণ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২৭০ কোটি মানুষ বাস করে যা বিশ্বের
জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি এবং গড় ৩০ বছর বয়সীদের শতকরা হার ক্রমবর্ধমান হারে
বাড়বে । এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক তাৎপর্যকে বাড়িয়ে বলার কিছু নেই। ভারত মহাসাগর বিশ্বের
পুরো সমুদ্রপৃষ্ঠের এক-পঞ্চমাংশ এবং এটি সারা বিশ্বের মানুষ ও অর্থনীতিকে সংযুক্ত করেছে।
এর বিস্তীর্ণ উপকূলরেখার মধ্যে রয়েছে হরমুজ প্রণালী থেকে শুরু করে মালাক্কা প্রণালী
পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচল পথ। সারা বিশ্বে সমুদ্রপথে পরিবহনকৃত
তেলের চালানের ৮০ শতাংশই ভারত মহাসাগরের জলসীমা অতিক্রম করে থাকে। আমাদের আবাসগ্রহের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মৎস্যভাণ্ডারও রয়েছে এ অঞ্চলে। সেগুলো এ অঞ্চলের মানুষের
কর্মসংস্থান ও বিশ্বজুড়ে মানুষের খাবার যোগানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে থাকে। তাই এই অঞ্চলের নেতৃত্বে ভারতের থাকা এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান
পুরো অঞ্চলের জন্য দারুণ একটা ব্যাপার।
ভারত মহাসাগর সম্মেলন (আইওসি) উদ্বোধনকালে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অঞ্চলের জন্য ছয়টি অগ্রাধিকার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক কূটনীতি গড়ে তুলে
একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নিশ্চিতের দিকে জোর দেন। তিনি সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়াদান,
অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমসহ ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তার
বিষয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন এবং আন্তর্জাতিক আইন
অনুসারে নৌ চলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতার অনুশীলনকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী এ অঞ্চলে 'শান্তি সংস্কৃতি'
এবং জনগণকেন্দ্রিক উন্নয়ন জোরদারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত
ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেক নারীদের বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ
দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা
জোরদার করা প্রয়োজন, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এ অঞ্চলে ও
অঞ্চলের বাইরেও ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উন্নয়নকে সহজতর করবে। তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে
নিরাপদ ও টেকসই উপায়ে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসনের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের সক্রিয়
সমর্থন চান। উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বহু শতাব্দী ধরে সামুদ্রিক কার্যকলাপের
কেন্দ্রস্থল এবং এটি অনেক আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়। বাংলাদেশ ভারতীয় মহাসাগর রিম
অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষের কাউন্সিলেরও বর্তমান
সভাপতি। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাবকে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সাদরে গ্রহণ করেছে।
গত কয়েক বছরে পৃথিবী নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত
হয়েছে। যখন ব্লকটি গঠিত হয়েছিল, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক দৃশ্যপট তুলনামূলকভাবে
শান্তিপূর্ণ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া এবং
ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থের সংঘাত ন্যূনতম ছিল। এটি এমন একটি সময় ছিল যখন বহুমেরুতা
তাদের অন্তর্নিহিত প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক
পরিবেশ উপভোগ করেছিল। আজ, বিশ্ব ধীরে ধীরে মেরুকরণ এবং ক্ষমতা, সম্পদ এবং আধিপত্যের
ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কোয়াড-চীন সংঘাত এবং ইউক্রেন যুদ্ধ চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে
পশ্চিমাদের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই প্রেক্ষাপটে ভারত দক্ষিণ এশিয়া
ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে 'নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার'-এর ধারণাপ্রচার করে আসছে । চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই),
কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি , ইন্দো-প্যাসিফিক
ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক এবং অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (ইউকেইউএস)
মতো নতুন কৌশলগত ও নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি
এখন বিকশিত হচ্ছে। তাই এমতাবস্থায় বাংলাদেশ তার মিত্র শক্তির সাথে সম্পর্ককে একটু ঝালিয়ে
নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। আয়োজক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এসব সমস্যা সমাধানের জন্য একটি আঞ্চলিক
প্লাটফর্ম পেয়েছে। উন্নত সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, সমস্ত আঞ্চলিক দেশগুলিকে
সমস্যাগুলি মোকাবেলায় একসাথে কাজ করতে হবে। ভারত ও শ্রীলংকা এই জোটকে পূর্ণ সমর্থন
দিয়েছে। তারা জোটের প্রতিটি দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বা যৌথ সামরিক মহড়া করার প্রতিশ্রুতি
দিয়েছে। বাংলাদেশ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে সহযোগিতা প্রত্যাশা করে এবং চ্যালেঞ্জ
মোকাবেলায় অন্যদের সহায়তা করতে চায়। সুতরাং, বাংলাদেশ ভারতের সাথে একত্রে এই প্লাটফর্ম
থেকে সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা, মাদক, অস্ত্র
ও মানব পাচারের মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধের বিরুদ্ধে কাজের সুযোগ আছে। দুই দেশ আশা করা
হচ্ছে এই সুযোগকে কাজে লাগাবে।
লেখক--হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।