ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে
বাংলাদেশের আর্থিক খাত থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাতের পর পালিয়ে থাকা এনআরবি গ্লোবাল
ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার বা পি কে হালদারকে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সাড়ে তিন
হাজার কোটি টাকা আত্নসাৎ এবং পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান
থেকে পি কে হালদারের বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনা সামনে আসার পর দুর্নীতি দমন কমিশন
তদন্ত নামলে গা ঢাকা দেন তিনি। দুদক পি কে হালদার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মোট
৩৪টি মামলা করেছিলো। এসব মামলায় তাদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও
পাচারের অভিযোগ আনা হয়। হাজার কোটি টাকা আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে বছর কয়েক
ধরে ফেরারী জীবনযাপন করা পি কে হালদার কানাডায় পালিয়েছিলেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছিলো, অবশেষে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন ভারতে। গত ১৪ মে শনিবার তাকে গ্রেপ্তার করে
ভারতের আর্থিক গোয়েন্দা দপ্তর। পি কে হালদারসহ ছয়জনকে আটক করা হয়, যার মধ্যে তার স্ত্রীও রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, ভারতে পি কে হালদার ও তার
সহযোগীদের বিপুল সম্পদ রয়েছে।
পি কে হালদারের গ্রেফতারের পর
নতুন করে আবারো আলোচনায় এসেছে ভারত বাংলাদেশ বন্দী বিনিময় চুক্তি। পি কে হালদারকে কিভাবে বাংলাদেশে
ফিরিয়ে আনা হবে এ নিয়ে চারদিকে চলছে নানামুখী আলোচনা। এ বিষয়ে পুলিশের একজন
উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বন্দী বিনিময় চুক্তির সকল নিয়ম মেনেই একজন বন্দী কে
ভারত সরকার বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে। একজন বন্দী কে হস্তান্তরে সাধারণত
সর্বোচ্চ তিন মাস সময় লাগতে পারে। বন্দী বিনিময় চুক্তির বিষয়ে তিনি জানান, কোনো বন্দী কে ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার ‘আনুষ্ঠানিকভাবে
যথাযথ মাধ্যমে’ সেই দেশের সরকারকে চিঠি দিবে।
চিঠি প্রাপ্তির পর সেই সরকার বিবেচনা করবে। পরে বিনিময়ের মত হলে তারা বন্দী কে ফেরত
দেবে। এদিকে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্দী প্রত্যার্পণ চুক্তি আছে, সে অনুযায়ী পি কে হালদারকে যাতে দ্রুত বাংলাদেশে ফেরত আনা যায়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তারা স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে
চিঠি দিয়েছেন। আবার গত ১৭ মে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন পিকে হালদারকে ফেরত
চাওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত
ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে বৈঠকে এ অনুরোধ করেন সচিব।
পিকে হালদারকে ফেরত পাঠানোর
বিষয়ে বাংলাদেশ অনুরোধ করেছে কি না- জানতে চাইলে ভারতের হাইকমিশনার বলেন, ‘এটি একটি
আইনি বিষয়। আমাদের কাছে যা তথ্য আছে, তার ভিত্তিতে
বাংলাদেশকে জানানো হবে। বুঝতে হবে, এটি কিন্তু বড়দিনের
কার্ড বিনিময় নয়। আমি মনে করি, এ ধরনের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়। সেটি আস্তে আস্তে হতে দিন। এ নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ
করছি।’
বাংলাদেশের সাথে শুধুমাত্র
ভারত ও থাইল্যান্ডের বন্দী প্রত্যর্পণ
চুক্তি আছে ৷ যাদের সাথে চুক্তি নেই তাদের সঙ্গে কেস টু কেস ডিল করা হয়৷ এটাকে বলা
হয় মিউচুয়্যাল লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট ট্রিটি৷বাংলাদেশ-ভারত বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি করে ২০১৩ সালে। এই চুক্তির
আওতায়ই বাংলাদেশের কারাগারে আটক উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া এবং তার দুই সহযোগীকে
ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয় ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বরে। আবার নারায়ণগঞ্জে সাত খুন
মামলার আসামী নুর হোসেনকে একই বছরের ১২ নভেম্বরে ফেরত দেয় ভারত। জানা গেছে
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি মাজেদকেও একই চুক্তির অধীনে
ফেরত দেয় ভারত, যদিও তাকে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার দেখানো
হয়েছে ৮ এপ্রিল। আর মোসলেহউদ্দিনকে আটক ও বাংলাদেশের কাছে হন্তান্তরের কথা ভারতীয়
গণমাধ্যমে এলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এখনো কোনো অফিসিয়াল তথ্য পাওয়ার কথা অস্বীকার
করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে ২০০৭ সালে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র বহিস্কার করে। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো চুক্তি না থাকলেও
পুশব্যাক পদ্ধতিতে তারা তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় এবং তার ফাঁসিও কার্যকর হয়। তাই
ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে তার নিয়মানুসারেই পিকে
হালদারকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে পারে ভারত তবে সেই চুক্তির একটি
ধারা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আলোচনা। এই চুক্তি
অনুযায়ী বাংলাদেশ বা ভারতের কোন অপরাধী আরেক দেশে লুকিয়ে থাকলে অথবা সাজাপ্রাপ্ত
অবস্থায় কারাগারে থাকলে তাকে নিজ দেশে হস্তান্তর করা যাবে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে
সেই দেশে কোন মামলা বিচারাধীন থাকলে তাকে হস্তান্তর করার কোন বিধান এই আইনে রাখা
হয়নি। কিন্তু পি কে হালদারের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়
একটি ব্যাপার হলো, এই ব্যক্তি ভারতের গুরুতর আইন
ভেঙ্গেছেন। তিনি বেআইনিভাবে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। সেই কারণে যদি ভারতের
কর্তৃপক্ষ আলাদা মামলা করে বিচার শুরু করে, তাহলে বিচার শেষ
হওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দী
বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী, আটক থাকা অথবা কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের ফেরত পাঠানো যাবে। এক্ষেত্রে
অন্তত এক বছর সাজা খাটতে হবে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পিকে
হালদার এবং সহযোগীদের সম্পদের খোঁজে অভিযান শুরু হলে নতুন করে ওঠে আলোচনা। তাদের
অবৈধ সম্পদের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ১০ জায়গায় অভিযানের খবর ভারতের সংবাদ
মাধ্যমে আসে। দেশটির
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এই
অভিযান চালায় পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধা, প্রীতিশ কুমার
হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের সহযোগীদের নামে থাকা
বাড়ি ও সম্পত্তিতে। এদের সবাইকে বাংলাদেশি নাগরিক উল্লেখ করে তাদের নামে
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তি রয়েছে বলে খোঁজ পাওয়ার কথাও এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে
জানায় ইডি। এর একদিন বাদেই পি কে হালদারের আটকের খবর এল। তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার
একটি ভিডিও-ও এসেছে সোশাল মিডিয়ায়। অর্থাৎ যদি পিকে হালদারের বিচার ভারতে শুরু হয়
আলাদাভাবে তবে তাকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া ধীর হবে।
সকল শংকাকে উড়িয়ে দিয়ে
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, আদালতের মাধ্যমে
নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তিন থেকে ছয়মাসের মধ্যে পি কে হালদারকে দেশে
ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে বাংলাদেশ থেকে ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রাহকের
টাকা আত্মসাৎ মামলায় প্রধান অভিযুক্ত পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানার বিরুদ্ধে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা চলছে। ফলে তাকে
এখনো ফেরত আনতে পারেনি বাংলাদেশ। নিয়ম অনুযায়ী, বন্দী ফেরত
আনতে হলে ভারতের কর্তৃপক্ষের কাছে বন্দীকে প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ
অনুরোধ জানানো হয়। এরপর আদালতের কাছে সেই বন্দীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুমতি
চাওয়া হয়। আদালত অনুমতি দিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সেই বন্দীকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী
বাহিনী বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী
বিজিবির সঙ্গে যোগাযোগ করে বৈঠকের মাধ্যমে বন্দী হস্তান্তর করে। বিজিবির কাছ থেকে
ওই ব্যক্তিকে গ্রহণ করে আদালতে হাজির করে বিচারের মুখোমুখি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তাই সঠিক করে বলা যাচ্ছেনা কবে পিকে হালদারকে ফেরত পাঠানো হবে। তবে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম
কুমার দোরাইস্বামী পিকে হালদারের বিষয়ে জানান,
‘বাংলাদেশ
সরকার ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে তথ্য দিয়েছে। ভারতীয় সংস্থা ওই তথ্য যাচাইয়ের
পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও অপরাধীদের দমনের জন্য সহযোগিতা রয়েছে।’
লেখক- -হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।