×
  • প্রকাশিত : ২০২৩-০৬-২৪
  • ৩৬৪ বার পঠিত
  • নিজস্ব প্রতিবেদক

এখন যেমন ঢাকায় গরু-ছাগলের হাটের বাহার, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে কোরবানির ঈদের আগে হাট বসত গুটিকয়। এর মধ্যে রহমতগঞ্জের হাটটি ছিল প্রসিদ্ধ, যেটি পরিচিত ছিল ‘গনি মিয়ার হাট’ নামে। এই গনি মিয়া [খাজা আবদুল গনি (১৮১৩–১৮৯৬)] ছিলেন ঢাকার নবাব। ব্রিটিশ আমলে তিনিই হাটটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিংবদন্তীর ঢাকা বইতে নাজির হোসেন এমন তথ্য দিয়েছেন। যদিও এ নিয়ে কিছুটা মতভেদও আছে।

এই হাটে আসার জন্য ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে গাইত, ‘ধার করো, কর্জ করো, গনি মিয়ার হাট ধরো।’

গনি মিয়ার হাটের বিশেষ আকর্ষণ ছিল মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম থেকে আসা নাদুসনুদুস সাদা গরু। কোরবানির জন্য ঢাকার বনেদি লোকদের সবচেয়ে পছন্দের ছিল এই গরু। খৈল, ভুসি, খুদকুঁড়া খেয়ে বেড়ে ওঠা এ গরুর মাংস বেশ সুস্বাদু। ঢাকাবাসী মিরকাদিমের গরুর জন্যই অপেক্ষা করতেন। বলা চলে, মিরকাদিমের গরু ছাড়া তাঁদের কোরবানি সম্পূর্ণ হতো না।

ফরাশগঞ্জ মহল্লার এককালের সরদার মাওলা বখশের ছেলে মোহাম্মদ আজিম বখশ আমাকে বলছিলেন, গনি মিয়ার হাটটি ছিল রহমতগঞ্জের চর এলাকায়, যা পরে বুড়িগঙ্গায় বিলীন হয়ে যায়। ছোটবেলায় গরু কিনতে মামা ও বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে ওই হাটে যেতেন তিনি।

বিভিন্ন বইপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের আগে ছাগল বা বকরি কোরবানি করা হতো বেশি। এ কারণে পুরান ঢাকায় ঈদুল আজহাকে বলা হয় বকরি ঈদ। দেশভাগের পরে আস্তে আস্তে গরু কোরবানির সংখ্যা বাড়ে।]


সপ্তাহখানেক আগেই ঈদের আমেজ
সেকালে পুরান ঢাকায় কোরবানির ঈদের আমেজ শুরু হয়ে যেত সপ্তাহখানেক আগেই। লালবাগের আমলীগোলার বাসিন্দা শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন তাঁর আত্মজীবনী আমার সাত দশক বইতে লিখেছেন, ‘ঈদের তিন–চার দিন আগে থেকে দাবড়ে বেড়াতাম পুরো মহল্লায়, কে কত বড় আর সুন্দর গরু কিনল, দেখার জন্য।’

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ঢাকায় স্বাভাবিক আকারের একটি গরুর দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত বড় গরু। আনোয়ার হোসেন আরও লেখেন, ১৫ বা ১৬ বছর বয়সে তিনি নিজে প্রথমবারের মতো কোরবানি দেন। ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় একটা শক্তিশালী আর তেজি ষাঁড় কেনেন ফতুল্লা থেকে। কুচকুচে কালো ষাঁড়টার শিং দুটো ছিল খুব বড় বড়। ৭ কি ৮ মণ মাংস হয়েছিল। তাঁদের পরিবারে খাসি বা বকরি কোরবানির রেওয়াজ ছিল না।

এখন যেমন ঈদের নামাজ পড়েই কোরবানি করার রেওয়াজ প্রচলিত, সেকালেও ছিল তা–ই। তবে অনেকেই ঈদের দিন বিকেলে, নয়তো পরের দিন সকালে কোরবানি দিতেন। কোরবানির মাংস বিতরণের সময় ঢাকাবাসী ছেলেমেয়েদের শ্বশুরবাড়িকে প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সাধারণত গরুর পেছনের রানটি একটি বড় ডালার ওপর হাতের নকশা করা চাদরে ঢেকে পাঠিয়ে দেন পরমাত্মীয়ের ডেরায়, বেয়াইবাড়ি থেকেও একটি রান আসে।

কোরবানি ঈদের রান্নাবান্না
কোরবানির মাংস দিয়ে ঢাকার লোকেরা কী কী খাবার রান্না করতেন, সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকাই খাবার বইতে। বটি কাবাব, কলিজি কাবাব, তিল্লিভুনা, গুরদা ভুনা, কিমা, মগজভুনা, নেহারি, কোফতা, চাপ, খাসির কল্লা রান্না, শিক কাবাব, গরুর কুঁজের মাংসের কাবাব—এসব হামেশাই রান্না হতো।

ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি বইয়ে পুরান ঢাকার বনেদি পরিবারের সন্তান সাদ উর রহমান লিখেছেন, কোরবানির মাংস দিয়ে কালিয়া, রেজালা, কোরমাসহ সব পদের খাবারই রান্না হতো, যা খাওয়া হতো রুটি বা পোলাওসহযোগে। কথাপ্রসঙ্গে তিনি আরও লেখেন, এখনো এ রীতির খুব বেশি রকমফের ঘটেনি। ঈদে পুরান ঢাকায় আরেকটি বিশেষ খাবার তৈরি হয়, তা হলো বাকরখানি রুটির ঝুরা মাংস।

কোরবানিসহ বিভিন্ন উৎসবের সময় কোপ্তা বা কোফতা তৈরি হয় হরেক রকম। হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ঢাকা: পঞ্চাশ বছর আগে গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঢাকায় যেভাবে কোফতা তৈরি হয়, তা অন্য কোনোখানে খুব কমই দেখা গেছে। কাঁচা গোশতের কোফতা, সিদ্ধ গোশতের কোফতা, কাঁচা-সিদ্ধ গোশতের মিশ্রিত কোফতা, খাস্তা কোফতা, কোফতার কালিয়া, কোফতার কোরমা-বুন্দিয়া অর্থাৎ মটরদানা পরিমাণ থেকে শুরু করে দুই সেরি পযন্ত কোফতাও তৈরি হয়।’

ঢাকা: পঞ্চাশ বছর আগে নামের এই বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। এই বইয়ে উনিশ শতকের শেষার্ধ ও বিশ শতকের প্রথমার্ধের ঢাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

ঈদের তৃতীয় দিন রাতে অনেক পরিবারে বানানো হতো শিক কাবাব। পরিবারের কর্তারাই এক রাতের জন্য বাবুর্চিগিরি করতে গিয়ে যাঁর যেভাবে খুশি মসলা মাখিয়ে সেঁকতেন, শিকে ঠিকমতো গাঁথতে না পেরে কিছু মাংস ফেলে দিতেন আগুনে। কারও কাবাব থাকত কাঁচা আবার কারওটা পোড়া। এসব নিয়ে হইচই, ঠাট্টা-তামাশাও কম হতো না। গরম গরম পরোটা দিয়ে শিক কাবাব খেয়ে অনাবিল আনন্দে ঈদের সময়টা ফুরাত। এখনো অনেক পরিবারে এ রকম আনন্দ-আয়োজন আছে।

অভিনব উপায়ে মাংস সংরক্ষণ
সেকালে রেফ্রিজারেটর তেমন ছিল না। তাহলে এত বিপুল পরিমাণ মাংসের কী গতি হতো?

সাদ উর রহমান জানাচ্ছেন, গরু কোরবানির পর রান ও সিনা আস্ত করে কেটে সারা রাত দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হতো। এতে মাংসের ভেতরের রক্ত ঝরে যেত। এরপর কেটে টুকরা করে গরুর চর্বির মধ্যে মাংস রাখা হতো ডুবিয়ে। কিছুদিন পরপর তা জ্বাল দেওয়ার প্রয়োজন হতো। এই পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা যেত কয়েক মাস পর্যন্ত। নিজের বইয়ে আনোয়ার হোসেন জানাচ্ছেন, ‘১০/১২টা বড় বড় পাতিলে চর্বি গলিয়ে তাতে মাংস ডুবিয়ে রাখতেন মা। কখনো কখনো মহররমের শিরনিতে কিংবা জিয়াফত খাওয়ানোর সময় এই মাংস কাজে লাগানো হতো।’

পুরান ঢাকার ঈদ ঐতিহ্যের কিছু হারিয়ে গেছে, কিছু টিকে আছে। এটাই কালের ধর্ম। তবে এখনো বেশ ভালো রকম আছে ঈদ-পরবর্তী আড্ডা। পুরান ঢাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবছরই ঈদ-পরবর্তী আড্ডার আয়োজন করে থাকে। তাতে ঢাকাইয়া চুটকি, স্মৃতিকথা, নাচ-গান পরিবেশিত হয়। এসব আড্ডার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও ফিরে আসে হারানো দিনের ঢাকা।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat